জন্ম তারিখ: ২৬ মার্চ, ১৯৮৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা :মাছ ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান :প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতাল,সাইনবোর্ড।
এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ যাত্রা ২০২৪ সালের জুলাই মাস, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবজ্জল অধ্যায় যোগ করেছে। ছাত্রজনতা কর্তৃক সরকারের প্রতি কোটা সংস্কারের মত অতি সাধারণ একটি দাবীকে সরকার যেভাবে দমননীতির মাধ্যমে একটি সহিংস পরিনতির দিকে ঠেলে দেয়, তার অন্যতম শিকার শহীদ মো: মিলন।তিনি ছিলেন সাধারণ একজন মাছ ব্যবসায়ী। পটুয়াখালী জেলার দুমকি থানার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের ঝাটরা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মিলন। ১৯৮৮ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণকারী এই যুবকের জীবন ছিল সরল ও স্বাভাবিক। তিনি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মাছ ব্যবসা করতেন। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম এবং দুই সন্তান দ্বীন ইসলাম ও সুমাইয়া ইসলামকে নিয়ে তার একটি সুখী পরিবার ছিল। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় তাকে এই সুখী জীবন থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২১ জুলাই, চিটাগাং রোডে বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। দুপুর ১২টার দিকে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। একজন নিরীহ মাছ ব্যবসায়ী হয়েও মিলন জাতীয় একটি আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছিলেন। তার মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্যই নয়, সমগ্র দেশের জন্য একটি বড় ক্ষতি। তার মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মানুষ কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। মোঃ মিলনের মৃত্যু একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে ু একটি সাধারণ মানুষের জীবন কি এত সহজে নেওয়া যায়? তার মৃত্যু আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তোলে, একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে আরও কতখানি পথ পাড়ি দিতে হবে? শহীদ মো: মিলনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তার মৃত্যু ব্যর্থ হবে না। তার আত্মত্যাগ অবশ্যই আগামীদিনের সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে প্রেরণা যোগাবে। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের রূপ নেয় যখন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ স্বতস্ফূর্ত অংশ নেয় এই আন্দোলনে। কিন্তু মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগে ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার আওয়ামী সরকারকে করে তোলে আরেক র্ফ্যাঙ্কেস্টাইন। আওয়ামী র্ফ্যাঙ্কেস্টাইন তখন নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেছে। এদেশের মাটি তার পৈতৃক সম্পদ, জনগণকে হলো তার প্রজা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। শেখ হাসিনার ভাষায়- ‘এই দেশ আমার বাপের’। সরকার আন্দোলকারীদের প্রতি ঠিক সেই ব্যবহারই করতে আরম্ভ করল যা তারা করেছিল ২০০৯ সালের পিলখানায় ও ২০১৩ সালের ৫ মে রাতের অন্ধকারে শাপলা চত্বরে। আন্দোলনকারীদের দমাতে খুনি হাসিনা লেলিয়ে দেয় ১৫ বছর ধরে গড়ে তোলা একনিষ্ঠ লাঠিয়াল বাহিনী পুলিশ ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুনি, ধর্ষক ও রাত দুপুরে পিটিয়ে মানুষ হত্যাকারী ছাত্রলীগের কুকুরদের। সরকার ডিজিটাল র্ক্যাকডাউন ও সারা দেশে কারফিউ জারি করে। আন্দোলন হয়ে উঠে সহিংস ও সারাদেশ অগ্নিগর্ভে পরিনত হয়। নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জেও ছাত্র জনতা আন্দোলনে নামে। গত ২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের সমর্থিত নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, পিস্তল, শটগান, ককটেল, লাঠিসোঁটাসহ নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেন। শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান ছাত্র-জনতার উদ্দেশে এলোপাতাড়ি গুলি ও আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। গনধিকৃত ওবায়েদুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে বলেন- আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ঠ। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা রাস্তায় অবস্থানরত ছাত্র-জনতার ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভীতির সৃষ্টি করে তাঁদের হাতে থাকা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ও মারধর করেন। শহীদ মিলন তখন মাছের আড়তে মাছ না পেয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরছিলেন। ফেরার পথে দুপুর ১২টার দিকে পুলিশের ছোড়া গুলি তার বুকে বিদ্ধ হয়, বুলেট তার হৃদয়কে বিদ্ধ করে মেরুদন্ডের বা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন মিলন। তাঁকে উদ্ধার করে সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থিত প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবে সন্ত্রাসীরা দুইটি অবুঝ শিশুকে করে পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ও এতিম, তার স্ত্রীকে করে বিধবা, বৃদ্ধ পিতা মাতাকে করে সন্তানহারা। ওই দিনই তার আত্মীয়স্বজন তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে এবং রাত দশটার দিকে জানাজা শেষে নিজ জেলা পটুয়াখালীর দুমকি থানার ঝাটারা গ্রামে দাফন দেওয়া হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের বক্তব্য শহীদ মিলনের স্ত্রী বলেন , মিলন সবসময় তার সন্তানদের বলতেন “সবসময় সত্য কথা বলবে, কখনো কাউকে কষ্ট দেবে না। আল্লাহ সব সময় তোমাকে সাহায্য করবে।“ ১৬ তারিখ রংপুরে আবু সাইদের মৃত্যুর পর অস্থিরতা প্রকাশ করছিলেন তিনি বারবার বলছিলেন, “ছেলেগুলোকে মারার তো কোন দরকার ছিল না, ছেলেগুলোকে মারার তো কোন দরকার ছিল না”। সোহাগ হাওলাদার, সম্পর্কে মিলনের চাচা। তিনি বলেন- মিলন ভালো লোক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ থাকতেন এবং ব্যবসা করতেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ মিলন সংসারের একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার পরিবার নিয়ে নারায়নগঞ্জ বিজেসি চত্তর এলাকায় বসবাস করতেন। নারায়নগঞ্জে তিনি ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও ছোট ভাইসহ ভাড়া বাসায় থাকতেন। বৃদ্ধ মা বাবা পটুয়াখালী দুমকীতে নীজের বাড়িতে থাকতেন। মা-বাবার সকল খরচ এবং অনার্স পড়ুয়া ছোট ভাইয়ের সকল খরচ তিনি বহন করতেন। বসতবাড়ি ছাড়া তাদের কোন জমি নেই। একমাত্র আয়ের উৎস মিলন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মারা যাওয়ায় পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ে এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এক নজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: মিলন জন্ম তারিখ : ২৬-০৩-১৯৮৮ পিতা : মো: হোসেন হাওলাদার মাতা : মমতাজ বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ঝাটরা, ইউনিয়ন: আঙ্গারিয়া, থানা: দুমকি, জেলা: পটুয়াখালী সন্তান : ২ জন ১. দ্বীন ইসলাম (৯ বছর) ২. সুমাইয়া ইসলাম (১ বছর ৬ মাস) পেশা : মাছ ব্যবসায়ী ঘটনার স্থান : চিটাগাং রোড আহত হওয়ার সময়কাল : দুপুর ১২টা শাহাদাতের সময়কাল : ২১ জুলাই ২০২৪, দুপুর ১২টা আঘাতের ধরন : বুকের বামপাশে গুলির আঘাত আক্রমণকারী : পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : ২২ক্ক২৮'৪৬.২"ঘ ৯০ক্ক২২'৩৯.৮"ঊ প্রস্তাবনা ১. বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে ২. এতিম দুই সন্তানের ভরন পোষণের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া ৩. অনার্স পড়ুয়া ভাইয়ের পড়াশনার খরচ বহন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ৪. স্ত্রী ও পরিবারের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা