Image of মো: নবীন তালুকদার

নাম: মো: নবীন তালুকদার

জন্ম তারিখ: ৩ মার্চ, ১৯৭৯

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: বরিশাল

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা :ব্যবসা, শাহাদাতের স্থান :পল্টন থানার সামনে।

শহীদের জীবনী

১৯৭৯ সালের এক অজপাড়াগাঁ, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মো: নবীন তালুকদার। তার জীবন শুরু হয় এক কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে। মাত্র তিন বছর বয়সেই হারান বাবাকে, যিনি ছিলেন তার জীবনের প্রথম ছায়া। বাবার মৃত্যু পরিবারকে নিক্ষেপ করে গভীর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে। অথচ ছোট্ট নবীন বুঝতেও পারেনি তখন, কত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার শৈশব। মায়ের কোলে থেকেও নবীন বেড়ে ওঠেন নানা বাড়ির মায়াময় পরিবেশে। তার মেজো মামা সৈয়দ খলিলুর রহমান হন তার জীবনের প্রধান অভিভাবক। মামার তত্ত্বাবধানে ছোটবেলার দিনগুলো কাটতে থাকে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শৈশবের সরলতা এবং কষ্টের ভার বহন করতেন নবীন। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠা এই তরুণের শৈশব ছিল অভাবের সাথে এক অন্তহীন সংগ্রাম। পড়াশোনা শেষ করার পর নবীন তার জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসায় নামেন। তিনি ধীরে ধীরে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেন, পরিবারকেও স্থিতিশীল এক অবস্থায় নিয়ে যান। ঢাকার শ্যামপুরে পরিবার নিয়ে নতুন জীবনের সূচনা করেন নবীন। সেখানে তিনি তার কর্মের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। বাউফলের মেঠোপথে হাঁটা সেই গ্রামীণ যুবক হয়ে ওঠেন শহরের এক সংগ্রামী নেতা। ঢাকায় বসবাস করার সুবাদে নবীন নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে যুবদলের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নবীন ছিলেন সামনের কাতারে। গ্রামের সরল জীবন থেকে উঠে আসা এই সংগ্রামী তরুণ, যিনি শৈশবের দারির্দ্য আর বাবার শূন্যতাকে জীবনের শক্তি বানিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, পরিণত হন একজন অদম্য যোদ্ধায়। নবীনের জীবনের গল্প কেবল একজন ব্যক্তির নয়; এটি একটি প্রজন্মের প্রতীক, যারা দারিদ্র্যকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখে।পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা নবীন তালুকদার ছিলেন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে একটি ছোট মুদি দোকান পরিচালনা করতেন। পাশাপাশি গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ছিল তার একটি নার্সারি। তাঁর অদম্য পরিশ্রমে সংসারের চাকা ঘুরছিল। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুর পর যেন সবকিছু থমকে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে দোকান, নিশ্চুপ হয়ে আছে নার্সারির সবুজ প্রান্তর। পরিবারটি যেন এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। তার মৃত্যুর পর পরিবারটির দুর্দশা অসীম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়িতে রয়েছে দুই শিশু—এক ছেলে ও এক মেয়ে; যারা এখনও শিক্ষার পথে এগিয়ে চলেছে। তাদের স্বপ্ন যেন মেঘের আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘরে রয়েছেন এক বৃদ্ধা মা, যিনি নানাবিধ রোগের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য নেই কোনো অর্থের সংস্থান, নেই কোনো অবলম্বন। নবীন তালুকদারের অনুপস্থিতি যেন একটি বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে, যা কোনোভাবে পূরণ হওয়ার নয়। শাহাদাতের ঘটনা ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই সারাদেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করে। শিক্ষার্থীরা সরকারের নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, আর এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। ১৪ জুলাই, আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এক উসকানি মূলক বক্তব্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের "রাজাকার" আখ্যা দিলে বিক্ষোভ আরো উত্তাল হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু এর বিপরীতে সরকার ও তার মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী একজোট হয়ে এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দমন করতে উঠে পড়ে লাগে। ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার দুপুরে পল্টন মডেল থানার অধীনে কালভার্ট রোডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের নেতৃত্বে র‌্যাব, বিজিবি এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত হামলা চালায়। গুলি, টিয়ার সেল, রাবার বুলেট, এবং গ্রেনেডের আঘাতে হতাহত হয় অসংখ্য মানুষ। এই রক্তাক্ত সংঘর্ষের মধ্যে মো: নবীন তালুকদার মাথা ও শরীরে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে দ্রুত ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানে সেলাইন দিতে ব্যর্থ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের কর্তব্যরত ডাক্তাররা নবীনকে মৃত ঘোষণা করেন। নবীন তালুকদারের মৃত্যুর পর শুরু হয় আরেকটি প্রহসন। তার মৃতদেহকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে, এমনকি তার লাশ গুম করার ষড়যন্ত্রও শুরু হয়। পুলিশের সহায়তায় ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করার চাপ দেয়া হয়। পল্টন, রমনা, এবং শাহবাগ থানায় ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ২০ জুলাই রাত ৮ টায় তার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের হাতে তুলে দেয়া হয়। নবীনের পরিবারের সদস্যরা তার লাশ শ্যামপুরের ঢাকার বাসায় নিয়ে আসে, যেখানে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে নবীনের লাশ নিয়ে তার পরিবার পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকুল গ্রামে রওয়ানা দেয়। ২১ জুলাই সকাল ১০টায় নবীন তালুকদারকে তার নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। ছাত্র আন্দোলনের এই শহীদ রেখে গেলেন একটি অন্তহীন বেদনা, যে বেদনা আজো নবীনের পরিবার ও আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে। আশিকুর রহমান ভাতিজা "আমার চাচা ছিলেন সত্যিই এক মহান মানুষ। এলাকায় যারই কোনো বিপদ-আপদ আসত, তিনি সবার আগে পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর হৃদয় ছিল দরদে ভরা। তিনি শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, পুরো এলাকাবাসীর জন্য নিবেদিত ছিলেন। এলাকার যুব সমাজকে ভুল পথে যেতে না দেওয়ার জন্য তিনি নানা ধরণের খেলাধুলা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতেন। তাঁর উদ্যোগে সবাই যেন ভালো কিছু করতে উৎসাহিত হতো। তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের সবার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।" সৈয়দ খলিলুর রহমানের মামা “নবীন তালুকদার আমার প্রিয় ভাগিনা। তার বাবা যখন মারা যান, তখন ওর বয়স মাত্র তিন বছর। সেই থেকে আমি তাকে আগলে রেখেছি। পড়াশোনার যাবতীয় খরচ দিয়েছি, যাতে সে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে। সে আমার বাসায় থেকে এইচএসসি পাস করেছে। অত্যন্ত মেধাবী ছিল নবীন। ডিগ্রি পাস করার পর জগন্নাথ কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা শেষ করতে পারেনি। সে ছিল সবার প্রিয়, মানুষের সাথে মিশে চলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। রাজনৈতিকভাবে সে বিএনপির সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিল। তার আকস্মিক মৃত্যু আমাদের সবার জন্য এক অমোচনীয় শূন্যতা রেখে গেছে।” এভাবে এই কথাগুলোকে সাহিত্যিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো, যেখানে আবেগ এবং মানুষের ভালোবাসা তুলে ধরা হয়েছে এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : মো: নবীন তালুকদার জন্ম সাল : ০৩/০৩/১৯৭৯ পেশা : ব্যবসা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ইন্দ্রকুল, ইউনিয়ন: সূর‌্যমনি, থানা, উপজেলা: বাউফল, জেলা: পটুয়াখালী পিতা : মৃত ফকরুল ইসলাম (ধলা) তালুকদার মাতা : মোছা. সাহিদা বেগম, বয়স: ৭০ শহীদের সন্তান সংখ্যা : ২ জন ১. মো: নূরনবী তালুকদার রুহান, ছাত্র: শ্যামপুর গভ: মডেল হাই স্কুল, নবম শ্রেনী, সম্পর্ক: ছেলে ২. হাজেরা তালুকদার রুহানা, ১৪ বছর, শ্যামপুর গভ: মডেল হাই স্কুল, নবম শ্রেনী, সম্পর্ক: মেয়ে আক্রমণকারী : পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী শাহাদাতের তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪ শাহাদাত স্থান : পল্টন থানার সামনে দাফন করা হয় : পারিবারিক কবরস্থান প্রস্তাবনাসমূহ ১: সন্তানের পড়া লেখার দায়িত্ব নিলে ভালো হবে ২: পরিবারের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করলে ভালো হবে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: নবীন তালুকদার
Image of মো: নবীন তালুকদার
Image of মো: নবীন তালুকদার
Image of মো: নবীন তালুকদার

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আতিকুল ইসলাম

মো: আতিকুর রহমান

মোহাম্মদ রনি

মো: আমিনুল ইসলাম আমিন

মো: নাহিদুল ইসলাম

মো: সিয়াম

মো: মিলন

মো. মনির

মো: আবুল বাশার

 মো: আরিফুর রহমান রাসেল

মো: বাচ্চু

মেহেদী হাসান

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo