জন্ম তারিখ: ৯ মার্চ, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : কার্পেট দোকানের কর্মচারী, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার এর নিচে
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম শহীদ সাইদুর রহমান ইমরান পটুয়াখালীর জেলার বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের উত্তর বড় ডালিমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইমরানের বাবা জনাব কবির হোসেন পেশায় শ্রমজীবী। বিভিন্ন দোকানে কাজ করে উপার্জন করেন। মা লাভলী বেগম পেশায় গৃহিণী। ভাইদের মধ্যে শহীদ সাইদুর রহমান দ্বিতীয়। বড় ভাই তৌফিকুর রহমান লিমন গুলবাগ মাদ্রাসায় আলিম পরিক্ষার্থী। ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান মাহিম ধোলাইপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। শহীদ সাইদুর রহমান এর বাবা প্রতিদিন যে আয় করেন তা দিয়ে তার সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। সংসার চালানোর পাশাপাশি তিন ছেলের লেখাপড়া করানো প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়ে মেজো ছেলে শহীদ সাইদুর রহমান ইমরান দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। সংসারের অভাবের কারণে তার লেখাপড়ার এখানেই ইতি ঘটে। একদিকে সংসার এবং অন্যদিকে ছোট ভাই ও বড় ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য তিনি ঢাকায় বাইতুল মোকাররম মার্কেটে একটি কার্পেটের দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেয়। মা-বাবা ও ভাইসহ তার পরিবার মীর হাজিরবাগ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে নিজস্ব কোন জমি জমা নেই। যেভাবে ঝরে গেল একটা তাজা প্রান জুলাই-আগস্ট '২৪ সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অতীতের যেকোনো ন্যায্য আন্দোলনেই এই ফ্যাসিস্ট সরকার বাধা প্রদান করেছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু ছাত্র বেশি সুবিধাভোগী হয় এবং অধিকাংশই সুবিধা বঞ্চিত থেকে যায়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ন্যায্য আন্দোলনের দাবি নিয়ে ২০১৮ সালে ছাত্র অধিকার পরিষদ গঠিত হয়। প্রচণ্ড আন্দোলনের দাবির মুখে সরকার কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। মূলত, ২০২৪ সালে এসে একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পুনর্বহাল ঘোষিত হলে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ছাত্রদের দাবি ছিল কোটা ব্যবস্থা ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী যৌক্তিক সমাধান দেওয়া। সরকার এই যৌক্তিক আন্দোলনে ভ্রুক্ষেপ না করায় আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ছাত্ররা জুলাইয়ের শুরু থেকে খুবই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ন্যায্য দাবি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ফ্যাসিস্ট সরকার যেকোনো আন্দোলনকেই ধামাচাপা দিতে তাদের উপর স্বৈরাচারী পুলিশবাহিনী, সন্ত্রাসী আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিত। ১৭ জুলাই ছাত্রদের কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে জমা হতে শুরু করে। বিকেল গড়াতেই স্বৈরাচারী সরকার ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে দেশি-বিদেশী অস্ত্র হাতে সন্ত্রাসী যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও গুণ্ডালীগকে ভাড়া করে নিয়ে আসে ছাত্রদেরকে দমন করার জন্য। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসলে সন্ত্রাসীরা চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর সেদিন গুণ্ডাবাহিনী রামদা, হকিস্টিক এবং দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে হেলমেট পড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপরে উপর্যুপরি নির্যাতন করতে থাকে। সেদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানেও চলে ছাত্রলীগের তাণ্ডবলীলা। সেদিন শিক্ষার্থীরা কোথাও নিরাপদ ছিল না। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার সেদিন ছাত্রদেরকে দমাতে পারেনি বরং ছাত্ররা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় যাত্রাবাড়ী হানিফ ফ্লাইওভারের নিচেও ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে প্রতিদিনই শহীদের সংখ্যা বেড়ে চলে। শহীদ সাইদুর রহমান সেই শহীদদের একজন। কে জানতো! বিজয়ের দিনেই সকলের মায়া ত্যাগ করে চলে যাবেন রবের দরবারে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তপ্ত হয় পুরো ঢাকা শহর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেন শহীদ ইমরান। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা নাজনীন বেগমকে বলেছিলেন, 'মা দেশ কিন্তু স্বাধীন হবেই, প্রয়োজনে ছাত্রসমাজের জন্য শহীদ হব।' এই কথা শোনার পর ইমরানের মা তার হাত ধরে বলেছিলেন, 'আজকে বাসা থেকে বের হইস নাহ বাবা।' মায়ের কোনো কথা না শুনেই বাসা থেকে বের হয়ে যায় ইমরান। শহীদ ইমরান যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সাথে শামিল হয়ে যান। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই ছাত্র-জনতার ঢল নেমে আসে। মুক্তিকামী জনতার ন্যায্য আন্দোলন কে নস্যাৎ করার জন্য পুলিশ এবং সন্ত্রাসী যুবলীগ এলোপাথাড়িভাবে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। ইমরান মিছিলের সামনে থাকায় কয়েকটা গুলি তার মাথায় এবং গলায় বিদ্ধ করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। সাথে সাথেই রাস্তায় ঢলে পড়ে শহীদ ইমরান। ছাত্র-জনতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইমরানকে উদ্ধার করে ইউনিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে তার জীবনের প্রদীপ নিভে গিয়েছিলো। ৫ আগস্ট রাত ১১ টার দিকে ইমরানের মরদেহ গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ৬ আগস্ট সকাল ১০ টার দিকে জানাজা শেষে জোমাদ্দার বাড়ি মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ সম্পর্কে অনুভূতি "ছেলে হিসেবে সাইদুর রহমান ইমরান খুবই ভালো ছিলো। নিয়মিত নামাজ পড়তো। কারো সাথে ঝগড়া করতো না। বিপদে জড়াতো না, সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলতো।" শহীদের চাচাতো ভাই, মো: বেলাল হোসেন জোমাদ্দার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মো: ইমরান হোসেন (১৮)। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা নাজনীন বেগমকে বলেছিল, 'মা দেশ কিন্তু স্বাধীন হবেই, প্রয়োজনে ছাত্রসমাজের জন্য শহীদ হব।' এই কথা শোনার পর ইমরানের মা হাত ধরে বলেছিলেন, 'আজকে বাসা থেকে বের হইস নাহ বাবা। 'মায়ের কোনো কথা না শুনেই বাসা থেকে বের হয়ে যায় ইমরান। তবে আর বাসায় ফেরা হয়নি তার। শহীদ হয়েছেন তিনি। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : সাইদুর রহমান ইমরান, জন্ম: ০৯-০৩-২০০২ পেশা : কার্পেট দোকানের কর্মচারী পিতা : কবির হোসেন, পেশা: শ্রমজীবী মাতা : লাভলী বেগম, পেশা: গৃহিণী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বড় ডালিমা, ইউনিয়ন: নাজরিপুর, থানা: বাউফল, জেলা: পটুয়াখালী বর্তমান ঠিকানা : মীর হাজিরবাগ, শ্যামপুর, ঢাকা আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার এর নিচে শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার, পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন পারিবারিক সহোযোগিতা প্রস্তাবনা ১. ইমরানের দুই ভাইয়ের পড়াশুনার ব্যাবস্থা করা ২. পরিবারটির পাশে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া