জন্ম তারিখ: ২০ জানুয়ারি, ১৯৮৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : সিকিউরিটি গার্ড শাহাদাতের স্থান : ৬ আগস্ট ২০২৪, পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়ে
শহীদ মো: মামুন ১৯৮৩ সালে পটুয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মোজাফফর হাওলাদার এবং তাঁর মাতার নাম মোছা: হেলেনা বেগম। তিনি নারায়নগঞ্জের পাগলা তালতলা বালুর ঘাটের একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার ছেলে জাকারিয়া ইসলাম জয় ৮ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে এবং মেয়ে জিদনীর বয়স ৪ বছর। তাঁর স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করবেন। কিন্তু তা আর হল না। জালিমের রোষানলে পড়ে প্রাণ দিতে হল তাঁকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ২০২৪ সালের ২২ জুলাই সরকারের ঘাতকরা তাঁকে গুম করে। ৬ আগস্ট তাঁর মৃত দেহ ফেরত দেয়। পারিবারিক অবস্থা শহীদ মোঃ মামুন একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না। দারিদ্রতার দায়ে নিজ জেলা পটুয়াখালী ছেড়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে এসে বাবা-মার সাথে বসবাস করতেন। ছোট থেকেই নারয়নগঞ্জে থাকতেন। ১০ বছর আগে তার বাবা মারা যান। মা এখন গ্রামে থাকেন। তার ১৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন। তিনি নারায়নগঞ্জের পাগলা তালতলা বালুর ঘাটের একটা কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। তার একমাত্র ছেলে জয় ৮ম শ্রেনীর ছাত্র। ৪ বছরের মেয়ে জিদনী এখনো সব কিছু বুঝার মত হয়ে উঠেনি। পিতার মৃত্যুতে সন্তানেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। শহীদ হওয়ার ঘটনা স্বৈরাচার সরকার শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৬ বছরের এদেশের মানুষের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। তাঁর শাসন-শোষণ আর নির্যাতনের মাত্রা অতীতের সকল সকল ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যায়। প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্যের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে ছাত্র-জনতা কোটা বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলনের ডাক দেয়। শুরুতে এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলন থাকলেও ক্রমেই গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকার ছাত্র-জনতার নায্য মেনে ত নেয় না উল্টো দমন করতে থাকে। আন্দোলনে পুলিশ বাঁধা প্রদান করলে সংঘর্ষ তৈরি হয়। সারা দেশের মানুষ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে। আন্দোলনের ডাকে সারা দেশের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সরকার তার দলীয় লাঠিয়াল এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগের হেলমেট বাহিনীর মাধ্যমে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা চালায়। তাতেও সাধারণ মানুষ পিছু হটেনি। দাবি আদায়ে অনড়। রাজপথে থেকে লড়াই করে। এরপর সকোর ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। গুম, খুন, গ্রেফতার ও হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন দমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। সরকার জনগনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আওয়ামী সরকারের পৈশাচিকতার অন্যতম একটি ছিল বিরোধী মতের মানুষকে রাতের আধারে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্যাতন করা। অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে ডিবি হেফাজতে এনে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি তাদেরকে আটকের কথা শিকার ও করত না। নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন তাদের কোন হদিস ও মেলে না। তাদেরি একজন ছিলেন শহীদ মোঃ মামুন। শহীদ মোঃ মামুনকে তার কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পাগলা তালতলা কুদ্দুস এন্ড সন্স বালুর ঘাট থেকে ২২ জুলাই দিবাগত রাত আইন শৃখলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে থানায় গেলেও পরিবারকে মামুনের সাথে দেখা করতে দেয়নি। এরপর প্রতিদিনই পরিবারের সদস্যরা মামুনের সাথে দেখা করার জন্য যেত, কিন্তু পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। পুলিশি হেফাজতে নিয়ে তাঁকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাঁকে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। এদিকে তাঁর পরিবার দেখা করতে আসলে পরিবারের কাছে মুক্তিপন হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। বলা হয় ৩০ হাজার টাকা দিলে তাঁকে সাধারণ কোন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সহজেই ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্যথায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে না। বরং কঠিন মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর কোনদির বের হতে পারবে না। কিন্তু তাঁর পরিবারের পক্ষে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া ওই মুহুর্তে অসম্ভব ছিল। পরিবারের লোকজন থানায় এসে অনেক আকুতি-মিনতি করে। কিন্তু নিষ্ঠুর পুলিশ তাদের কোন আকুতি-মিনতি শুনে না। বরং নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মামুন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবস্থা যখন বেগতিক আর বাচার কোন সম্ভাবনা নেই তখন পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রতিদিনের মতো গত ৬ আগস্ট তাঁর পরিবারের লোকজন দেখা করতে গেলে পুলিশ জানায়, মামুন হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় মামুনের নিথর দেহটা পড়ে আছে; অথচ পরিবারকে মৃত্যুর খবরটাও জানানো হয়নি। এভাবেই পুলিশ মামুনকে হত্যা করে। এমন অমানবিক মৃত্যু তাঁর পরিবার কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। বাবার এমন মৃত্যুতে ছেলে মেয়ে দুজনিই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দাফন-কাফন ৬ আগষ্ট মঙ্গলবার মধ্য রাতে মামুনের লাশ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি গলাচিপা উপজেলার পানখালী গ্রামে। নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় লাশ। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনভূতি শহীদের মামা সিরাজুল গাজী বলেন, সে খুব ভালো ছিলো, সবার প্রতি সে সম্মান প্রদর্শন করতো। তার মার প্রতি সে খুব খেয়াল করতো। তাঁর আয়েই সংসার চলত। নিজে কিছু করতে না পারলেও স্বপ্ন দেখেছিলেন ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ বানাবেন। কিন্তু তা আর হল না। এক নজরে শহীদ মো: মামুন নাম : শহীদ মোঃ মামুন জন্ম : ২০-০১-১৯৮৩ জন্ম স্থান : পটুয়াখালী পেশা : সিকিউরিটি গার্ড পিতা : জনাব মোজাফফর হাওলাদার মাতা : মোছাঃ হেলেনা বেগম শহীদ হওয়ার তারিখ : ৬ আগস্ট ২০২৪, পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হয়ে স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পানখিলা, ইউনিয়ন: চিকনিকান্দি, থানা:গলাচিপা, জেলা: পটুয়াখালী বর্তমান ঠিকানা : ৬৪ পাগলা পূর্ব পাড়া, ইসলামিয়া বাজার, কুতুবপুর, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ প্রস্তাবনা শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান। শহীদের সন্তানদের পড়াশুনা সহ যাবতীয় খরচ বহন করা। শহীদের মা-বাবার খরচ বহন করা।