জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : সবজি ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান : বংশাল
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই সংগ্রামী। সংগ্রামে, বিপ্লবে, গণঅভ্যুত্থানে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে বাঙালি শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে আলোচিত হতে থাকবে। অর্জনের ঝুলিতে জমা হয়েছে অনেকগুলো মণিমাণিক্য। যেমন: ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণ গণঅভ্যুত্থান, ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সর্বশেষ ৫ আগস্টের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। ৫ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা এজন্য যে এই আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষ বিদেশি পরাশক্তির সাহায্য ছাড়াই একটি দখলদার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের একক হকদার দাবী করা আওয়ামী লীগের সরকার বার বার বলতো তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। আর এই স্বাধীনতার পিছনে ছিল ভারত। এভাবে ভারতকে মহিমান্বিত করে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণকে তারা বার বার অবজ্ঞা করেই চলতো। দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সরকার ছিল অনির্বাচিত। এই ফ্যাসিস্ট সরকারটিকে টিকিয়ে রাখতে মূখ্য ভূমিকা রাখে ভারত। তাই জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন করি। দিনটি ছিল সোমবার। বাঙালি জাতির স্মরণীয় একটি দিন। টানা ১৫ বছর পর পরাজয় হলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। কোটা আন্দোলনের জেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন শেখ হাসিনা। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লং মার্চ টু ঢাকা ছিল আজ। এর আগে দুই দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পুরো জুলাই মাসজুড়ে চলে এই আন্দোলন। একপর্যায়ে সরকার কোটা সংস্কার করে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার জেরে এক দফা দাবি উঠে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আজ বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ উপেক্ষা বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। কিন্তু ঐদিন সকালেও পুলিশ, আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন বাহিনীকে দাঁতাল দানবের মতো মানুষ হত্যা করতে দেখা যায়। রাজধানীর বংশালে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে আসা অন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে পুলিশ, জঅই, এপিবিএন সদস্যরা। পুলিশের গুলিতে অনেকের সাথে নিহত হয় মো: মনির। শহীদ মনির বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। তিনি ১৯৯০ সালে ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জয়নাল আবেদীন একজন শ্রমিক। মাতা শাহেদা বেগম একজন গৃহিণী। শহীদ মনির ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। যেভাবে শহীদ হয় শহীদ মোঃ মনির ছোট থেকেই পিতামাতার চক্ষু শীতলকারী সন্তান ছিলেন। ছোট থেকে লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু পরিবার অসচ্ছল হওয়ায় পড়াশোনা বেশি আগাতে পারেননি। তিনি অনেক কষ্ট করে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালান। পরে বাধ্য হয়ে পরিবারের জন্য ঢাকায় এসে সবজি ব্যবসার কাজ শুরু করেন। শহীদ মনির অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসে ছিলেন ভালো টাকা পয়সা ইনকাম করে তার পরিবার ও ছেলে সন্তান কে ভালো রাখবে ও তাদের পড়ালেখার খরচ চালাবে কিন্তু স্বপ্ন গুলো যেন স্বপ্নই রয়ে গেলো। ঘাতকের একটা গুলি এসে তার জীবনের সকল চাহিদা আর চাওয়া পাওয়া গুলো নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলন কে ঘিরে গড়ে ওঠে সরকার পতনের আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ কে নির্বিচারে গুলে করে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির ডাক দেয়। জুলাই মাসের ১৭ তারিখ কঠিন আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ১৮ তারিখে দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ হাতে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ছাত্রদের উপর গুলি চালায় কিন্তু তাতেও তারা থেমে থাকেনি সেই দিন রাত থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় মিথ্যা ছলনা করে। প্রায় ৫ দিন নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখে সরকারি পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালায়। অনেক লাশ গুম করা হয়। সর্বশেষ ছাত্রদের দাবি মেনে না নিয়ে আরো বেশি আঘাত হানার চেষ্টা করে তৎকালীন অবৈধ হাসিনা সরকার। ছাত্ররা রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা করে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ৫ তারিখ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। যেখানে সাধারণ ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে সেখানে একজন সুস্থ মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারে না তাই মনির ৫ তারিখ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি তে যোগ দেন। ৫ আগস্ট দুপুরে শহীদ মনির আন্দোলনে যোগ দেয়। বংশালে আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালায় ঘাতক পুলিশ। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে দুপুর ১২ টায় পুলিশের গুলি এসে লাগে মনিরের পেটে। ঘাতকের বুলেটটি পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। ৫ আগস্ট রাত ১১ টায় পিজি হাসপাতালে শাহাদাত বরণ করেন এই সাহসী যোদ্ধা। শহীদ মনিরের অভাবগ্রস্থ পরিবার তার মৃত্যুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সংসারে তার স্ত্রী, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে রয়েছে। শহীদ সম্পর্কে মন্তব্য মো: কায়ছার সম্পর্কে শশুর বলেন, এমন একটি ছেলে আর আমি পাবো না। আমার মেয়ের ২টি সন্তানসহ মেয়ের একটি ঘর নেই। তার জন্য সবার সুদৃষ্টি কামনা করছি। স্ত্রীর জানান, এক ছেলে এক মেয়ে রেখে তার বাবা মারা গেলো। বাবার লাশ পেয়ে মেয়ে বলে ভাই বাবাকে নিয়ে ঘরে চলো। ছেলে তার বাবাকে প্রথম দেখে এমনি নিয়ে আসছে পরে যখন দেখে বাবা আর কথা বলতেছেনা তখন ছেলে বুঝছে বাবা মারা গেছে । তখন বাবারে ধরে চিৎকার দিয়ে মুখে চুমু দিচ্ছে। আমার ছেলে মেয়ে এখন এতিম তাদের দেখার এখন আর কেউ নেই। আপনারা ছেলে মেয়েদের খেয়াল রাখবেন। তাদের বাবার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তার বাবাকে জান্নাত নসিব করেন। মো. লোকমান হোসেন (স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক) বলেন, শহীদ মো. মনির খুব পরিচিত ও আত্মীয়। আমরা একই ওয়ার্ডে বসবাস করি। সে আমার ভাগিনা সম্পর্কে প্রায় কথা বলতেন। তার শত সমস্যা শর্তেও ছেলেকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করিয়ে একজন ভালো আলেম বানানোর ইচ্ছা ছিলো। সে ঢাকা শহরে সামান্য একটা কাঁচা মালের ব্যবসা করতেন তার পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। বিধবা স্ত্রীর থাকার একটি ঘর নেই। দুইটি সন্তানের পড়ালেখার অনিশ্চয়তায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সর্বজনের ঈমানের দাবী। মো: নওয়াব (আপন চাচা) বলেন, এরকম ভাতিজা আর ফিরে পাবো না। এরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় ছিলো। কোন বাড়ী ঘর নেই। তাই আপনাদের সকলের সু-দৃষ্টি কামনা করছি। প্রিয় ভাইকে হারিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বোন স্বপ্না বলেন, আমার ভাই আর আসবে না। আমি চাই আমার ভাই পরকালে ভালো থাকুক। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ শহীদের পূর্ণ নাম : শহীদ মো. মনির (৩৪) পেশা : সবজি ব্যবসায়ী স্থায়ী ঠিকানা : আলতাফ আলী দফাদার বাড়ি, শম্ভুপুর, ভোলা বর্তমান ঠিকানা : ঢাকা জন্ম তারিখ : ০১/০২/১৯৯০ পিতা : মো. জয়নাল আবদীন (৫৫) পেশা : শ্রমিক মাতার নাম : শাহেদা বেগম (৪৫) পেশা : গৃহিণী শহীদের ছেলে-মেয়ে : ১. মো: আবির (০৯) : ২. মোছা: জুনহা (০৫) পারিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৪ জন পারিবারিক আয় : ৬০০০ টাকা আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ০৫/০৮/২০২৪ সময়: দুপুর ২টা মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ০৫/০৮/২০২৪, রাত ১১টা, বংশাল যেভাবে সহযোগিতা করা যায় ১। শহীদ ভাতা দেয়া যেতে পারে ২। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করা যায় ৩। স্ত্রীর কর্মসংস্থান