জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৭ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : মোবাইলের দোকানে কাজ করতেন, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী কাজলাব্রিজ
মো: সিয়াম ১ জানুয়ারি ২০০৯ সালে ভোলা জেলার উসমানগঞ্জ চরফ্যাশনে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ সিয়াম ছোট থেকেই পিতা-মাতার চক্ষু শীতলকারী সন্তান ছিলেন। ছোট থেকে লেখাপড়ায় খুবই আগ্রহী ছিলে কিন্তু পরিবার নিম্নবিত্ত হওয়ায় খুব বেশি আগাতে পারেননি। তিনি অনেক কষ্ট করে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালান। পরে বাধ্য হয়ে পরিবারের জন্য অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় মোবাইলের দোকানে কাজ শুরু করেন। পারিবারিক অবস্থা শহিদ সিয়ামের পরিবারে একমাত্র তার বাবা মোঃ জিয়া ছাড়া উপার্জনের আর কেউ নেই । তার বাবা অনেক কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। বাবার এই কষ্টার্জিত আয় দিয়ে তাদের জীবন চালাতে অনেক কষ্ট হয়। একবেলা খেতে পেলো তো অরেক বেলা খেতে পায়না সিয়ামের পরিবার। তার উপর আবার ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ। অর্থাভাবে কায়ক্লেশে জীবন যাপন করছে তারা। ছোট ভাই ইয়ামিন (১২) উসমানগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার পড়ালেখার খরচ বহন করতো প্রিয় সহদোর সিয়াম। আল্লাহ তায়ালা তার পরিবারের উপর রহম করুন। আমিন। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলন কে ঘিরে দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে সরকার পতনের তীব্র আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ কে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ থেকে কঠিন আন্দোলন শুরু হয়। ১৮ তারিখে দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন দমন করতে ঘাতক পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা হাতে ধারালো ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী নিরীহ-নিরস্ত্র মুক্তিকামি ছাত্র-জনতার উপর মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি হায়েনার দল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সেই দিন রাত থেকে পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দেওয়া হয় মিথ্যা ছলনা করে। প্রায় ৫ দিন নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখে স্বৈরাচারী সরকারের মদদপুষ্ট তাবেদার পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের উপর নৃশংস হামলা চালায়। সর্বশেষ ছাত্রদের দাবি মেনে না নিয়ে আরো বেশি মরণ কামর দেয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা করে ততকালীন অবৈধ হাসিনা সরকার। ছাত্র-জনতা রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা করে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ৫ তারিখ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। দিনটি ছিলো ১৭ জুলাই ২৪। জুলাই মাসের শুরু থেকে দেশ ব্যাপী চলতে থাকা কোটা সংস্কার আন্দোলন আরো গুরুতর হয় ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার বলিষ্ঠ বজ্রকণ্ঠ আবু সাঈদ ঘাতক পিশাচ পুলিশ কর্তৃক হত্যার পর থেকে। তাই সবার উদ্দেশ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক আসে। সেই সুবাদে সিয়াম তার খালাতো ভাই সহ একসাথে চলমান আন্দোলনে শরীক হয়। শাহাদাত বরণ ছাত্ররাই অজেয়-এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এ সফলতা যতটা না সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে চলাকালীন তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। এর ফলে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ছাত্র আন্দোলন 'সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ' এর মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহীত। এ শ্রেষ্ঠত্ব যুগে যুগে লুফে নেয় তরুণ ছাত্র-জনতা। একজন সচেতন ছাত্র দেশ ও জাতির সক্রিয় কার্যকর প্রতিবাদী জনশক্তি। এ তরুণ ছাত্র সমাজ যখন কোনো যৌক্তিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে তখনই তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করে ঝাপিয়ে পড়ে শহীদ মোঃ সিয়াম। পরিবারের অভাব অনটন মাথায় রেখে স্বপ্ন দেখা তরুণ প্রজন্মের আইডল সিয়াম অল্প বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তা কখনো কল্পনাতীত ছিল না। ১৭ জুলাই বুধবার বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছে খবর পেয়ে সকাল আন্দোলনে চলে যান শহীদ মোঃ সিয়াম। যাত্রাবাড়ী কাজলাব্রিজ গিয়ে সকলের সাথে আন্দোলনে একত্রিত হন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ঘাতক পুলিশ বাহিনী এসে সমবেত ছাত্র-জনতার উপর মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে থাকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সমবেত নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। গুলি খেয়ে রাস্তায় পরে যায় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী। এক পর্যায়ে খুনি পুলিশ কর্তৃক ছোঁড়া গুলিবিদ্ধ হয় মোঃ সিয়াম। মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান তিনি। স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক পুলিশের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো সবকিছু। ভেঙে গেলো পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি নিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন। প্রায় ৩০ মিনিট রাস্তায় পড়ে থাকেন শহীদ মো: সিয়াম। তারপর পুলিশ চলে গেলে ছাত্র-জনতা এসে তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে নিকটস্থ হাসপালে ভর্তি করায়। স্বৈরাচার হাসিনার ভয়ে সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত ব্যক্তিরা তাকে ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। অনেক সময়-ক্ষেপণ করে তারা। তারপর ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে এক ডাক্তার এসে ভালোভাবে না দেখেই তার মৃত্যুর ঘোষণা দেয়। উপস্থিত ছাত্র-জনতা তাকে বারবার অনুরোধ করে, আরও একটু ভালো করে দেখার জন্য। সে জানায় এর চেয়ে ভালো করে দেখতে পারবে না। ছাত্র-জনতা তার কাছে শহীদের ডেট সার্টিফিকেট চাইলে সে তা দিতে অস্বীকার করে এবং রেগে গিয়ে প্রশাসন ডেকে আনার হুমকি দেয়। অতঃপর নিরুপায় ছাত্র-জনতা শহীদ সিয়ামকে বাড়িতে নিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাত নসীব করুন আমিন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের মন্তব্য জেঠাত ভাই জসিম বলেন, সিয়াম খুব ভালো ছিলো। খুব মিশুক ছিলো, কেউ কোনো কাজ দিলে সে সাথে সাথে করে দিতো, কখনো না করতো না। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুক। সিয়ামের জেঠা বলেন, সিয়াম আমার দোকানে থাকতো আর পড়ালেখা করতো। তাকে আমি বড় করেছি। আল্লাহ তাকে জন্নাত দান করুন। স্কুল শিক্ষক ফরহাদ বলেন, সিয়াম ভালো ছাত্র ছিলো। অন্যায়মূলক কোন কাজ করতো না। সে স্কুলে আসতো তবে সংসারের অভাব অনটন থাকায় সে স্কুল মাঝে মাঝে গ্যাপ দিতো। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন। মমতাময়ী মা সুরমা বেগম প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমার দুইটা ছেলে দিলো। আল্লাহ কোন মেয়ে দিলো না। আল্লাহ একটা ছেলে নিয়ে গেলো। মারা যাওয়ার সময় আমার বাবা কি কষ্ট না পাইলো। মাকে ডাকছে না বাবাকে ডাকছে? আমার বাবা আমার খুব খেয়াল রাখতো। বাবা প্রতিদিন আমাকে ফোন করতো। ফোন দিয়ে সকলের অবস্থা জিজ্ঞেস করতো। নিষ্ঠুর পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করে মেরেছে। আল্লাহ ওদের বিচার করুক। পারিবারিক অবস্থা দুই ভাই ও বাবা-মা সহ সিয়ামের পরিবার। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় পড়ালেখার পাশাপাশি ঢাকায় মোবাইলের দোকানে চাকরি করতেন। ছোট ভাই ইয়ামিনের পড়ালেখার খরচও তিনি বহন করতেন। একনজরে শহীদ মো: সিয়াম পূর্ণ নাম : মো: সিয়াম জন্ম : ০১-০১-২০০৯ জন্মস্থান : উসমানগঞ্জ চরফ্যাশন বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: আক্কু পাটোয়ারি বাড়ী, ইউনিয়ন: হাসানগঞ্জ, থানা: চরফ্যাশন , জেলা: ভোলা পিতার নাম : মোহাম্মদ জিয়ার, রিক্সাচালক মায়ের নাম : মোসাম্মদ সুরমা, গৃহিণী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান : ১৭ জুলাই ২০২৪ ঘটনার তারিখ ও স্থান : ১৭ জুলাই ২০২৪, যাত্রাবাড়ী কাজলাব্রিজ আহত হওয়ার সময় : ১২টা ৪৫ মিনিট আঘাতকারী : স্বৈরাচারি সরকারের ঘাতক পুলিশ বাহিনী শহীদ হওয়ার তারিখ, সময় ও স্থান : ১৭ জুলাই ২০২৪, যাত্রাবাড়ী কাজলাব্রিজ প্রস্তাবনা ১. বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে ২. ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানোর ব্যবস্থা করা ৩. এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা