জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : কাজের বুয়া, শাহাদাতের স্থান : শান্তিনগর মোড় ফ্লাইওভার থেকে ৪ তলার বারান্দায়
মোসা: লিজা ১ জানুয়ারি ২০০৪ সালে ভোলা জেলার অন্তর্গত বোরহান উদ্দিন ইউনিয়নের সাচরার দেউলিয়া শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জয়নাল শিকদার পেশায় একজন কৃষক আর মাতা ইয়ানুর বেগম একজন গৃহিণী। পরিবারের আর্থিক অবস্থা শহীদের পিতা জয়নাল শিকদার কৃষি কাজ করে পরিবার চালাতেন। কিন্তু বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় সামান্য অর্থ দিয়ে সংসার চালাতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাবা, মেয়ে লিজাকে কাজের জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। বাবা মায়ের ঔষধ সহ সংসার পরিচালনা করার জন্য লিজা (২০) খেয়ে না খেয়ে কঠোর পরিশ্রম করে ঢাকায় মানুষের বাসায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করতেন। লিজার সামান্য কিছু উপার্জন দিয়ে পরিবারের খরচ বহন করলেও বাবা মায়ের জন্য কিছুটা হলেও সহায়ক ছিলো কিন্তু এখন লিজার মৃত্যুর পর সহযোগিতার দ্বারও সংকুচিত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তার পরিবারের ব্যয় ভার বহন করা তার বাবার জন্য কষ্টসাধ্য ব্যপার। একদিকে লিজার মা বাবার বয়স বেড়ে গেছে কাজ করার মত অবস্থা নেই। অন্য দিকে ভাই বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সবায় আলাদা অবস্থান করেন। এই দিকে লিজার মৃত্যু যেন কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মত না। এক দিকে সারাদেশে যোগাযোগ বন্ধ অন্য দিকে ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে অবৈধ সরকার দেশের মধ্যে সব এলাকায় মানুষের উপর নির্বিচারে এমন গণহত্যা চালায়, সে সময় লিজার মৃত্যুর খবর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্রেক্ষাপট দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয় । আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসীস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। যেভাবে শহীদ হন মানবতার চিন্তা না করে শুধু ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে শুরু করেন গুলি ও টিয়ার্শেল সহ নির্বিচার গুলিবর্ষণ। সেই গুলি এসে লাগে সাধারণ একজন বাসাবাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে কর্মরত লিজার শরীরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনি গুলি বিদ্ধ হন। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকার শান্তি নগর বাসায় অবস্থানরত ছিলেন লিজা। দুপুর ৩ টার দিকে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে ঘাতকের ছোঁড়া একটা গুলি এসে তার পেটে লাগে। তৎক্ষনাত তাকে কাকরাইল আরোরা স্পেশালাইজড হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে তার অবস্থা বেশি খারাপ হয়। পরে ঐ হাসপাতাল থেকে গুরুতর হলে লিজা কে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই সোমবার বিকাল ৩.৫০ মিনিটে ওঈট থাকা অবস্থায় পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন। আমিন। জানাজা ও দাফন শহীদের লাশ নেওয়ার মত কেও নেই। কে তাকে নিয়ে যাবে? কিভাবে দেশের বাড়িতে নিয়ে যাবে? সব যায়গায় কারফিউ জারি করেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। তার লালিত-পালিত পুলিশ দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার। অবশেষে কোন রকম চেষ্টার পর এম্বুলেন্স ভাড়া করে লিজার লাশ এলাকায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। হাজার হাজার মানুষ লিজার বাড়িতে লাশ দেখতে আসে। মা-বাবা আত্মীয় স্বজনরা ও এলাকাবাসীর চোখের পানি কেও ঠেকায়ে রাখতে পারেনি। নিজ এলাকায় জানাজা শেষে তাকে সমাহিত করা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদের বাবা জয়নাল শিকদার বলেন, আমার কলিজার টুকরা সন্তান আমার মেয়ে চলে যাওয়ায় আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে। আমার অভাবের সংসার। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে মেয়েকে কাজে দিয়েছি। আমি নিজে অচল আমার একসাইড অচল হয়ে গেছে। মেয়ে যা বেতন পাইতো তা দিয়ে আমার সংসার কোনরকমভাবে চলে যেতো। আমার মেয়ে ইতিহাসের অন্যতম গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লব, অভ্যুত্থানের অন্যতম অকুতোভয় এক ত্যাগী সৈনিক। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘাতকের গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করে সে। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন। মা ইয়ানুর বলেন, আমার মেয়ে খুব ভালো ছিলো। তার কোন অপরাধ ছিলো না। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিলো না। আমার ৫ মেয়ে ২ ছেলে ৩ মেয়ের পর ১ ছেলে দিছে আল্লাহ । কিন্তু অভাবের সংসার ছিলো এদেরকে লালন পালন করতে টাকা পয়সা লাগবে। এতো টাকা পাবো কোথায়? অভাবের সংসারে আর্থিক সাহায্য করার জন্য মেয়েকে ঢাকায় কাজে দিয়েছি। কে জানে অমার বুক টা খালি করে পরিবার কে ছেড়ে অকালে চলে যাবে। সে যে বাসায় কাজ করতো তারাও খুব ভালো ছিলো । যখনই ইচ্ছা বাড়ি চলে আসতে বলতাম। মেয়ে আসতে না চেয়ে বলতো, আমি এখানে ভালো আছি আমার কোরআন পড়ার কিছু বাকি আছে এইটুকু শেষ করে আসবো । পরে তোমরা আমার বিয়ে দিয়ে দিয়ো। প্রস্তাবনা: পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা দিয়ে সহযোগীতা করা। একনজরে শহীদ মোসা: লিজা পূর্ণ নাম : মোসা: লিজা জন্ম : ০১ জানুয়ারি ২০০৪ জন্মস্থান : ভোলা, বোরহান উদ্দিন পেশা : কাজের বুয়া বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- দেউলিয়া শিবপুর, ইউনিয়ন- সাচরা, থানা- বোরহান উদ্দিন, জেলা- ভোলা পিতার নাম : জয়নাল শিকদার মায়ের নাম : ইয়ানুর বেগম পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ৬ জন ঘটনার তারিখ ও স্থান : ২১ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২টা, শান্তিনগর মোড় ফ্লাইওভার থেকে ৪ তলার বারান্দায় আহত হওয়ার সময় : ২১ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২টা আক্রমণকারী/আঘাতকারী : স্বৈরাচারি সরকারের ঘাতক পুলিশ বাহিনী শহীদ হওয়ার তারিখ, সময় ও স্থান : ২২ জুলাই সোমবার বিকাল ৩.৫০ মিনিটে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওঈট শহীদের কবরের অবস্থান : বাড়ির পাশে সামাজিক কবরস্থান