জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: মুদী দোকান কর্মচারী, শাহাদাতের স্থান : মিরপুর ১০, ঢাকা
"একটা সোনার পাখি হারিয়ে গেল" শহীদ পরিচিতি মো: হৃদয় হাওলাদার। ঝালকাঠি সদরে জন্ম নেওয়া একজন সংগ্রামী, একজন সাদামাটা মানুষের প্রতিচ্ছবি। ঝালকাঠীর শিরযুগ গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এই তরুণের জন্ম ১ জানুয়ারি, ২০০৪। পিতার নাম শহিদ হাওলাদার। পিতা পেশায় সহযোগী রাজমিস্ত্রী। যিনি জীবনের ৪০টি বসন্ত পার করেছেন কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। আর মা কুলসুম বেগম, বয়স মাত্র ৩৬ পেশায় গৃহিণী। ছোট ভাই রিয়াদ হাওলাদার (১২) ও ছোটবোন মরিয়ম (০৫)সহ পাঁচ সদস্যের এই পরিবার জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলছিল। পিতার দিনমজুরি আর শহীদের মুদির দোকানে কাজ করে অর্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারের দৈনিক চাহিদা মেটানো হতো। মাসিক ১৫,০০০ টাকা আয়ে জীবনটা কোনোভাবে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু স্বপ্নের পরিধি যেন সবসময়ই সীমাবদ্ধ ছিল। তবুও তিনি ছিলেন এক দৃঢ়চেতা যুবক। হৃদয় শুধু পরিবারের প্রতিই নয়; দেশের প্রতিও ছিলেন অসীম দায়বদ্ধ। ১৯ জুলাই ২০২৪ সন্ধ্যা ৬ টায় স্বৈরাচারী হাসিনার পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাত ৮টায় তার জীবনাবসান ঘটে। ঘটনার বিবরণ মিরপুরের এভিনিউ-৫ এলাকার সরু গলির শেষ মাথায় একটি ছোট্ট বাসায় বাস করতেন শহীদ মো: হৃদয় হাওলাদার। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা তার শৈশব থেকেই তাকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তোলে। দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভর করে চলা পরিবারে দারিদ্রতা যেন নিত্যসঙ্গী। পাঁচ সদস্যের এই পরিবারে সংসার চালানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। শহীদ হৃদয় ছোটবেলা থেকেই পরিবারের জন্য কিছু করার তীব্র ইচ্ছা লালন করতেন। হৃদয় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতির বাস্তবতায় খুব বেশি এগোতে পারেননি। পরিবারের জন্য কিছু করতে হবে এই চিন্তাই তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। মিরপুরে একটি মুদির দোকানে চাকরি নেন, সেখানে মাসিক ১৫০০০ টাকার বিনিময়ে কাজ শুরু করেন। এই সামান্য আয়ে কোনোভাবে সংসারের খরচ চললেও তা ছিল খুবই কষ্টকর। এর আগে, ফুসফুসের অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন যা তার পরিবারের ওপর মারাত্মক ধরনের বোঝা হিসেবে বিরাজ করছিল। সেই ঋণ শোধ করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। শরীরের অসুস্থতা নিয়ে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। অর্থনৈতিক সংকট, ঋণের বোঝা আর পারিবারিক দায়িত্ব হৃদয়কে আরও দৃঢ় করে তোলে। তিনি নিজের কষ্টকে পাশ কাটিয়ে পরিবারের জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার মনে ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। বৈষম্য, দুর্নীতি আর সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। হৃদয় কখনো সমাজের অবহেলিতদের প্রতি তার সহমর্মিতা হারাননি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হলে হৃদয়ও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা তার কাছে হয়ে উঠল নৈতিক দায়িত্ব। ১৯ জুলাই বিকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হন হৃদয়। তখন ছিল সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র হামলায় আহত নিহতদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। সেই সাথে আন্দোলনের উত্তেজনাও তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তবুও দমতে রাজি নয় আন্দোলনকারীরা। সকল পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা রাজপথে ছিল। তাদের কণ্ঠে শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান। পুলিশ ও হাসিনার গুন্ডা বাহিনীর হামলায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মিরপুর-১০। সন্ধ্যায় ঘটল নির্মম ঘটনাটি। পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় হৃদয়ের বুকে। গুলিটি সরাসরি তার ফুসফুসে আঘাত হানে। ঠিক সেই জায়গায়; যেখানে আগে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। যন্ত্রণায় কাতর শহীদকে তার সহযোদ্ধারা যথাদ্রুত মিরপুরের আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সময়ের অভাবে এবং পরিস্থিতির গুরুতর অবস্থায় শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর আগেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। রাত ৮টায় হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিবার, বন্ধু, সহযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে তাকে বিদায় জানাতে কালশী কবরস্থানে ভোর ৫টার দিকে দাফনের আয়োজন করেন। শহীদ হৃদয়ের জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও তার সংগ্রামের গল্প আজও জীবিত রয়েছে। জুলুম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার লড়াই চিরকাল আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। হৃদয়ের আত্মত্যাগ একটি প্রদীপের মতো আলোকিত আগামীর পথ দেখাবে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শহীদ হৃদয় হাওলাদারের মৃত্যুতে তার পরিবারে গভীর সংকট নেমে এসেছে। উল্লেখযোগ্য কোনো জমিজমা না থাকার কারণে এবং হৃদয়ের দীর্ঘদিনের ফুসফুসের রোগের চিকিৎসার জন্য প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ঋণ নেওয়ার ফলে তারা সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে গিয়েছেন। হৃদয় মাসে ১৫,০০০ টাকা উপার্জন করে পরিবারের দেখাশোনা করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যুতে সেই উপার্জনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারটি আরও বেশি বিপদে পড়েছে। হৃদয় বাদে ৪ সদস্যের পরিবার চালাতে গিয়ে হৃদয়ের বাবা হিমশিম খাচ্ছেন। স্বজনদের বক্তব্য শহীদ হৃদয় হাওলাদারের চাচাতো বোন কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তিনি বলেন, “ও কেমন ছিল বলতে গেলে বুক ফেটে যায়। অমায়িক ব্যবহার ছিল ওর। কথায়, কাজে, চলনে-বলনে কাউকে কষ্ট দিতো না। নিজের ছোট ভাইয়ের চেয়েও ওকে ভালো জানতাম। খারাপ কোনো রেকর্ড ওর নাই। ওর যখন ফুসফুসে অপারেশন হয়েছিল সারা এলাকার মানুষ ওর জন্য কেঁদেছিল। যে যেভাবে পেরেছিল সহযোগিতা করেছিল। পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পরেও একইভাবে মানুষ কেঁদেছে ওর জন্য। বংশের বড় ছেলে ছিল। লম্বা-চওড়া দেখতে ভালো ভাইটি আমাদের আশা ভরসার প্রতীক ছিল। ফ্যামিলিটা দেখাশোনা করতো। ওর কোনো তুলনা নাই। একটি সোনার পাখি হারিয়ে গেল। সত্যিই ভাইটি আমাদের সম্পদ ছিল।” প্রস্তাবনা এই পরিবারের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। বর্তমানে তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রথমত, একটি নিরাপদ বাসস্থানের অভাব রয়েছে। বর্তমানে শহীদ পরিবারটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছে। দ্বিতীয়ত, বাবার জন্য একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা হলে তিনি স্বাবলম্বী হতে পারবেন। তৃতীয়ত, পরিবারের ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন। কেননা, তাদের লেখাপড়া অনিশ্চয়তায় পড়েছে। যদি এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে পরিবারটি পুনরায় স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাবে। একটি নিরাপদ বাসস্থান, বাবার ব্যবসার সুযোগ এবং ছোটদের শিক্ষার নিশ্চয়তা তাদের জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। একটু সহযোগিতা তাদের পরিবারে সচ্ছলতা আনতে পারে। কিন্তু প্রিয় স্বজনকে হারানোর অভাব কখনোই পূরণ হবার নয়। এক নজরে শহীদ পরিচিতি শহীদের পূর্ণ নাম : মো: হৃদয় হাওলাদার জন্ম তারিখ : ০১-০১-২০০৪ জন্মস্থান : ঝালকাঠী পেশাগত পরিচয় : মুদী দোকানের কর্মচারী মাসিক আয় : ১৫০০০/- আয়ের উৎস : মুদি দোকানে চাকরি স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শিরযুগ, ইউনিয়ন: শিরযুগ প্রতাপপুর, থানা: সদর, জেলা: ঝালকাঠী বর্তমান ঠিকানা : বাসা: এভিনিউ-৫, এলাকা মিরপুর ১০, থানা: কাফরুল, জেলা: ঢাকা পিতার নাম : মো: শহিদ হাওলাদার পিতার পেশা ও বয়স : সহযোগী রাজমিস্ত্রী, ৪০ বছর মায়ের পেশা ও বয়স : গৃহিনী, ৩৬ বছর মায়ের নাম : কুলসুম বেগম ছোট ভাই : রিয়াদ হাওলাদার (১২), ৫ম শ্রেণিতে পড়ে ছোট বোন : মরিয়ম (৫) পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন ঘটনার স্থান : মিরপুর ১০ আক্রমণকারী : কাফরুল থানার পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯ জুলাই ২০২৪, সন্ধ্যা ৬ টা মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ৮ টা শহীদের কবরের অবস্থান : কালশী, মিরপুর