জন্ম তারিখ: ১৮ জুন, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : দিনমজুর, শাহাদাতের স্থান : নতুনবাজার বাঁশতলা, গুলশান, ঢাকা
বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে সংযুক্ত নতুন নাম মো: বাহাদুর হোসেন মনির। এই তরুণ যুবকের জীবনাবসান ঘটেছে আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে। শহীদ মো: বাহাদুর হোসেন মনির বাল্যকাল থেকেই পিতামাতার চক্ষু শীতলকারী সন্তান ছিলেন। ছোট থেকে লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু পরিবার অসচ্ছল হওয়ায় পড়াশোনায় বেশি আগাতে পারেননি। তার পরিবার অনেক কষ্ট করে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালান। অভাবের তাড়নায় ও পরিবারের প্রয়োজনে স্বল্প বয়সেই তাকে জীবনের সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী এই তরুণ যুবক দেশের উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকার নতুনবাজার বাঁশতলায় আন্দোলনরত জনতার উপর পুলিশ গুলি চালায়। সেই ভয়াবহ ঘটনায় বাহাদুর হোসেন মনিরের বুকের ডান পাশে গুলি লেগে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু আন্দোলনরত জনতার উপর সরকারী নির্যাতনের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। বাহাদুর হোসেন মনিরের মৃত্যু আমাদের সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের জন্য আত্মাহুতি দান করা মানুষের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তার মৃত্যু বৃথা যাবে না। তার আত্মাহুতি দেশের মুক্তির আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করবে। আমরা আশা করি, বাহাদুর হোসেন মনিরের হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে এবং দেশের জনগণ সুখ-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। শহাদাতের প্রেক্ষাপট শুরুটা হয়ে ছিলো জুলাই মাসের কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। নিরীহ নিরস্ত্র আন্দোলনকারিদের উপর সরকারের দমন পীড়ন কারনে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। যার শেষ হয় স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগ ও পলায়নের মাধ্যমে। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদসহ সারাদেশে আরও ৬ জন আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হলে ছাত্রজনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৭ তারিখ কঠিন আন্দোলন শুরু হয়, বাড়তে থাকে লাশের সংখ্যা। তারপর ১৮ তারিখে দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ হাতে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। তাতেও তারা থেমে থাকেনি সেই দিন রাত থেকে ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে দেওয়া হয় মিথ্যা ছলনা করে। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে সিলেট গিয়েছিলেন বাহাদুর হোসেন মনির। সরকারের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল হলে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেয় ছাত্রসমাজ। কর্মসূচীতে যোগদান করতে তড়িঘড়ি করে ফিরে আসেন ঢাকায়। প্রতিদিনই বাবা-মাকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আন্দোলনে, অংশগ্রহণ করতেন সমন্বয়কদের ঘোষণা করা বিভিন্ন কর্মসূচিতে। বাবা কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে তিনি আন্দোলনে যাওয়ার কথা গোপন করতেন। ১৬, ১৭, ১৮ জুলাই দেশব্যাপী ব্যাপক সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা তার মনকে অনেক বেশি অস্থির ও ভারাক্রান্ত করে তোলে। পিতা আবু জাফর আদরের সন্তানকে দেশের সংঘাতময় পরিস্থিতির কথা স্বরন করিয়ে দিয়ে বাইরে বেরুতে নিষেধ করলে তিনি বলেন, “আন্দোলনে সফল হতে হলে আরও রক্ত দিতে হবে। একদিনতো মরতেই হবে, যদি সে মৃত্যু হয় দেশের জন্য তবে তাই হবে সবচে বড় পাওয়া”। এই বলে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। সেদিনই ছিলো শহীদ মোঃ বাহাদুর হোসেন মনিরের জীবনের শেষ দিন। ১৯ জুলাই জোহরের নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে রাস্তায় নামলে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। সেদিন সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে সবচেয়ে বেশি তান্ডব চালায় সরকারি গুন্ডাবাহীনি। দুষ্কৃতিকারীদের মূহুর্মূহু গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। নতুনবাজার বাঁশতলা এলাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন মনির। পুলিশের ছোড়া তপ্ত সীসা তার ডান বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আঘাত করে তার পেছনে থাকা আরেক আন্দোলনকারীকে, মা.... বলে লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। বুকের তপ্ত রক্তে সিক্ত হয় রুক্ষ জমিন। তিনি তার কথা রেখেছেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দিয়েছেন নিজের রক্ত, রঞ্জিত করেছেন দেশের মাটি। আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে তার আত্মত্যাগ। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সাথীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেন। হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্সে করে তার লাশ নিয়ে যাওয়ার সময়ও চতুর্পাশে চলছিল পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি। গ্রামের বাড়িতে শহীদের লাশ দাফনেও পরিবারকে পুলিশি ঝামেলায় পরতে হয়। শহীদ মো: বাহাদুর হোসেন মনির অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসে ছিলেন। ভালো টাকা পয়সা ইনকাম করে ভালো পাত্রী দেখে বিয়ে করবে আর প্রতিবন্ধী বোন কে ভালো রাখবে ও তাদের পড়ালেখার খরচ চালাবে। তার স্বপ্ন গুলো যেন স্বপ্নই রয়ে গেলো। ঘাতকের একটা গুলিতে তার জীবনের সকল চাহিদা আর চাওয়া পাওয়া গুলো নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করূন আমিন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের বক্তব্য শহীদ মো: বাহাদুর হোসেন মনির সম্পর্কে মোঃ রায়হান খালাতো ভাই বলেনঃ সে আমার বন্ধু ও আত্মীয়। ফোন করে জানতে পারি মনির পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বরণ করে। তাকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত। শহীদের বাবা বলেনঃ আমার ছেলে গুলি খেয়ে সাথে সাথে মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পর পুলিশ ও আওয়ামিলীগ আমাদের সাথে খুব খারাপ আচারণ করেছে। তারা এত নিচু ও পশুর মত, আমার ছেলেকে নিয়ে আসতে গেলে পুলিশ আটকে দেয়। মমতাময়ী মা ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, সে আমারে ছাইরা চলে গেছে। আমার কলিজার ছেলে ডারে হারিয়ে আমরা দিশে হারা। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা মো: বাহাদুর হোসেন মনিরের পরিবার একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। তার বাবা আবু জাহের (৫৭) বয়স্ক হওয়ায় রিকসা চালিয়ে কোনমতে ছোট বোনের চিকিৎসা, পড়ালেখার খরচ সহ পরিবারের বিভিন্ন আর্থিক দাবি পূরন করে থাকতেন। মা জাহানারা বেগম (৪৯) ও অসুস্থ, তেমন কিছু করতে পারেন না। শহীদ পরিবারটি আর্থিকভাবে নিঃস্ব ও দুর্বল। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: বাহাদুর হোসেন মনির জন্ম তারিখ : ১৮-০৬-২০০৭ পিতা : মো: আবু জাহের মাতা : জাহানারা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ভাষানচর ৪ নং ওয়ার্ড, ইউনিয়ন: রসুলপুর , থানা: শশীভুবন, জেলা: ভোলা বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত পেশা : দিনমজুর ঘটনার স্থান : নতুনবাজার বাঁশতলা, গুলশান, ঢাকা আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯-০৭-২০২৪, বিকাল ৩টা শাহাদাতের সময়কাল : ১৯-০৭-২০২৪, বিকাল ৩টা আঘাতের ধরন : বুকের ডান পাশে গুলি আক্রমণকারী : পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : নিজ গ্রামের বাড়িতে, হরাজী মসজিদের পাশে প্রস্তাবনা ১. পরিবারকে নিয়মিত ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে ২. শারীরিক প্রতিবন্ধী বোনের দায়িত্ব নেওয়া ৩. রিকশাচালক পিতাকে ভালো কর্মসংস্থান করে দেওয়া