জন্ম তারিখ: ১ ডিসেম্বর, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : শিক্ষার্থী ও বিকাশ মার্কেটিং কর্মী, শাহাদাতের স্থান :মিরপুর আইফেল হাসপাতাল
মো: নাহিদুল ইসলাম ছিলেন একজন সাহসী ও সংগ্রামী বীর। তিনি ২০০৩ সালের ১ ডিসেম্বর ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানার অন্তর্ভুক্ত উত্তর ভাটামারা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো: আব্দুল জলিল ৫৭ বছর বয়সী একজন পরিশ্রমী মানুষ, আর মা বিবি ফতেমা একজন গৃহিণী। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান এবং সকলের নয়নের মণি। বাবার অসুস্থতার জন্য পরিবার ও বোনদের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অভাবের সংসারে বড় হওয়া নাহিদুল ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করতে শিখেছিলেন। করে ৮ম শ্রেনি পর্যন্ত পড়ালেখা চালান। অভাবের তাড়নায় ও পরিবারের প্রয়োজনে স্বল্প বয়সেই তাকে জীবনের সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী এই তরুণ যুবক দেশের উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে। পাশাপাশি তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং সদালাপী ব্যক্তি। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি রাজধানীতে বিকাশ মার্কেটিং এর কাজ শুরু করেন তিনি। নিজের প্রয়োজনের তুলনায় পরিবারের জন্যই বেশি অর্থ পাঠাতেন। এই কঠিন জীবনের মধ্যেও শিক্ষার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট ছিল। একজন কর্মী এবং শিক্ষার্থী হিসেবে তার দ্বৈত জীবন ছিল বাস্তবতার কষাঘাতে ভরা, কিন্তু তবু তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করতেন। দারির্দ্যের কষ্ট, কঠোর পরিশ্রম, আর পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা নাহিদুলকে একটি বাস্তবিক জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক করে তুলেছিল। শহীদ নাহিদুলের অর্থনৈতিক অবস্থা একমাত্র পুত্র সন্তান নাহিদকে হারিয়ে পাগল প্রায় অবস্থা তার পিতামাতার। নাহিদুল ইসলাম ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবার কোন কর্মসংস্থান না থাকায় নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি ঢাকায় গিয়ে বিকাশের মার্কেটিং কর্মী হিসাবে যোগদান করেন তিনি, এর মাধ্যমে পরিবারের কিছু সহযোগিতা করার চেষ্টা করেতেন। কিন্তু একদিন, বাবা মায়ের কোল শূন্য করে অপ্রত্যাশিতভাবে শহীদ হন নাহিদুল। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের মধ্যে শুরু হয় হাহাকার। এখন তারা চিন্তিত, কিভাবে চলবেন এবং কিভাবে সংসারের খরচ চালাবেন। নাহিদুলের অভাব তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে এবং গোটা পরিবারটি এখন নিঃস্ব। এই দুরবস্থার মধ্যে, তারা আশা করে সমাজ সহায়তা করবে, যাতে তাদের জীবনে কিছুটা আলো ফিরিয়ে আনা যায়। এইজন্য বোধ হয় কবি লিখেছেন- দুঃখরা কেন এভাবে মিছিল করে আসে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবনের স্পন্দন থামিয়ে দিয়ে ? দুঃখরা কেন বার বার ওদেরকেই ভালোবাসে ওদের হাসি-কান্নায় ভরপুর জীবনকে স্তব্ধতায় ঢেকে দিয়ে ? শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি কর্মের কারণে পৃথিবীতে মানুষ অমর হয়। মানুষ চলে গেলেও থেকে যার তার কর্ম। তেমনি মৃত্যুর পরে ও শহীদ নাহিদুল ইসলাম অমর। এলাকাবাসীর মুখে মুখে আজ ও তার সম্পর্কে বন্দনা। চাচাতো রাকিব বলেন, “আমরা দুই ভাই এক সাথে আন্দোলেনে শরীক হই তার পর আমি প্রথমে ছরা বুলেট খাই, খাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমার ভাই গুলি খায় গুলি খাওয়া সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের ডাক্তার ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন। এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারিনি সে আমার সাথে নাই। দোয়া করি আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন এবং শহীদের উচ্চ মাকাম দান করুন।” সহপাঠি ও ভাতিজা মো: নিহাদ বলেন, “চাচা আমার বাড়ি আসলে সব সময় আমাদের সাথে থাকতেন। আমাদের সাথে খেলাধুলা করতেন। চাচা আজ আমাদের মাঝে নাই আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আল্লাহ তাকে জান্নাত বাসি করুক। শহীদের উচ্চ মর্যাদা দান করুক।” সহপাঠী জাকির হোসেন বলেন, “নাহিদ ভাই আর আমি একই আন্দোলনের কর্মী ছিলাম। একসাথে কাজ করতাম। তার অনেক স্মৃতি আমার সাথে জড়ানো। যে স্মৃতি ভুলতে পারিনা।” আন্দোলনের দায়িত্বশীল আল আমিন ভাই বলেন, “আমি যখন ২০১৮ সালে দৌলত থানা শাখার সভাপতি ছিলাম তখন দ: বড়ধলিদাখির মাদ্রাসার দায়িত্বমীল হিসেবে নাহিদকে পাই। নাহিদ আন্দোলনের একজন একনিষ্ট কর্মী ছিলেন। আমি যখন কোনো প্রোগ্রামের কথা বলতাম সে এলাকার এবং প্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্রদেরকে প্রোগ্রামে হাজির করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি সে যেভাবে দ্বীনের কাজে সেহযোগিতা করতো আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে সেভাবে জান্নাতের মেহমান হিসেবে সহযোগিতা করুন। (আমিন)” বাবা আব্দুল জলিল বলেন, “আমি আমার একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। আমার ছেলে হাজারের মধ্যে একজন ছিলো। এখন পর্যন্ত কোনো বিষয়ে কেউ কখনো কোনো বিচার দেয় নাই। ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো ছেলেটা বড় হয়ে একটা ভালো চাকরি করবে কিন্তু আল্লাহ নিয়ে গেলো। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।” মা বিবি ফাতেমা বলেন, “আমার একমাত্র কলিজা ছিল। আমার ৩ মেয়ের পরে আল্লাহর কাছে কেন্দে কেন্দে আল্লাহর কাছে চেয়ে নিচে আল্লাহ আমার পুতের চাকুরি লাগবেনা শুধু আমি মরলে আমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কোরআন, পড়বে মাটি দিবে। এই আশা করে আল্লাহর কাছে পুত চাইছি আল্লায় দিছে কিন্তু আগুন পানি থেকে বাচিয়ে পুতরে বড় করেছি কিন্তু পুলিশ গুলি করে মারলো। আমরা এর বিচার চাই। আমার পুতও মরলো একবার এক মুহূর্তের জন্য পুতের বাবা ঘরে থাকতে পারে নাই পুলিশের ভয়ে পুলিশ থাকলো পুতের এখন আর আমি দেখি নাই আমি ঘুম থেকে উঠলে কলিজার ধড়ফড় করে। পুতে মরার সময় কি কষ্ট করে মরছে। আমি দেখি নাই আমার খোকা কোথায় চলে গেল। আল্লাহ আমার বাবাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।” আজ নাহিদ নেই কিন্তু তার প্রতিবাদী চেতনা, তার আত্মত্যাগ, তার শহীদ হওয়ার বেদনা যেন সবকিছুই থেকে যায় তার পরিবারের চোখের জলে, এলাকার মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। ঘটনার প্রেক্ষাপট শহীদ নাহিদুল ইসলামের জীবনের কাহিনী যেন এক অশ্রুসিক্ত পরিহাস। জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়গুলোতে যখন একজন যুবক নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা ও পরিবারকে নিয়ে ভাববে, ঠিক তখনই নাহিদুলের জীবন গতি বদলে গেল পরিবারের অমোঘ দায়িত্বের চাপে। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংসারের চাকা সচল রাখা এবং বাবা মা কে ভালো রাখা। কিন্তু নাহিদুলের জীবনের গল্প অন্ধকারে মোড় নেয় যখন সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয় এবং অপ্রত্যাশিতভাবে শহীদ হয়ে যায়। মূলতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল জুলাই ‘২৪ জুড়ে। ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, এবং সেমিনারের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরেছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনটি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের নায্য দাবী না মেনে চালাচ্ছিলো অত্যাচারের স্টীমরোলার। সারাদেশ জুড়ে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোঁড়া হচ্ছিলো ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে। খালি হয়ে যাচ্ছিলো হাজারো মায়ের বুক, পিতাহারা হয়ে পড়ছিলো হাজারো শিশু। আর নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই আন্দোলনে যোগদান করেন নাহিদ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। এই কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে বন্ধু ও চাচাতো ভাই রাকিবকে সাথে নিয়ে মিরপুর ১০ এ শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নাহিদ। আন্দোলনে মিছিল চলাকালিন ধাওয়া ও পালটা ধাওয়া হয়। এক পর্যায় প্রথমে রাকিব বুলেট খায় তার কিছুক্ষণ পরে পুলিশের গুলি এসে বুকে লেগে পিছন দিয়ে বের হয়ে যায় নাহিদের এবং সেখানেই লুটিয়ে পড়ে নাহিদ। সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন তাকে। এছাড়াও পুলিশ ও বিজিবির নৃশংস গুলিতে ১১৯ জন শাহদাতবরণ করেন। এরপরপরই ছাত্র আন্দোলন রুপ নেয় গণআন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। এদিন রাস্তায় ছাত্রদের চাইতেও বেশি ছিল নানান শ্রেণির, নানান পেশার মানুষ যাদের একটাই দাবী ছিল স্বৈরাচার হটানো। বলাবাহুল্য সারাদেশের চেয়ে রাজধানী ঢাকা ছিল বেশি অগ্নিগর্ভ, যেখানে এইদিনে শহীদ হয়েছিল শত শত মানুষ। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা-বাড্ডা, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর ১ ও ১০, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, সাভার ছিল আন্দোলনের মূল হটস্পট। এদিন রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। একইসাথে বিচ্ছিন্ন করা হয় সকল ইন্টারনেট সেবা। ফলে তথ্যহীনতায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সারাদেশ। এই রক্তক্ষয়ী ১৯ জুলাই পিতা-মাতার কোল খালি করে শহীদ হন নাহিদুল ইসলাম। নাহিদুলের মৃত্যু শুধু তার পরিবারকেই নয়, আমাদের সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজও যখন তার স্মৃতি আমাদেরকে স্পর্শ করে, তখন মনে হয় সে যেন একজন সাহসী যোদ্ধা, যার হৃদয়ে ছিল নিখাঁদ দয়া। নাহিদুল আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার আদর্শ ও সংগ্রাম চিরকাল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এই দোয়াই আজ সকলের মুখে। শহীদ পরিবারকে সাহায্যের প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা-১: বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে প্রস্তাবনা-২: বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে প্রস্তাবনা-৩: শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ পুরো নাম : মো: নাহিদুল ইসলাম জন্ম : ১/১২/২০০৩ পেশা : শিক্ষার্থী ও বিকাশ মার্কেটিং কর্মী স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: উত্তর ভাটা মারা, ইউনিয়ন : বড় মাইনকা, থানা: বোরহান উদ্দিন, জেলা: ভোলা পিতার নাম : মো: আব্দুল জলিল। বয়স : ৫৭ বছর মাতার নাম : বিবি ফতেমা, পেশা : গৃহিণী ভাই বোনের সংখ্যা : ৩ জন বোন : ১) শাহিনা বেগম, বয়স- ২৭, বিবাহিত : ২) নূর নাহার, বয়স- ২৫, বিবাহিত : ৩) সুফিয়া, বয়স -২৩, বিবাহিত ঘটনার স্থান : মিরপুর ১০ আক্রমনকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ : ১৯/০৮/২০২৪, বিকাল ৫টা মৃত্যুর তারিখ ও সময় স্হান : ১৯/০৮/২০২৪, মিরপুর আইফেল হাসপাতাল শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : নিজ গ্রাম, পারিবারিক কবরস্থান