জন্ম তারিখ: ২৫ জানুয়ারি, ১৯৯৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৩১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : চাকরিজীবি, শাহাদাতের স্থান : ধানমন্ডি পপুলার হসপিটাল
মানুষের ছেলেরা শহীদ হচ্ছে, তোমার ছেলে আঁচলে বাঁইধা রাখবা নাকি! দোয়া করো যেন শহীদ হই।’ সেলিম তালুকদারের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। বেড়ে ওঠা ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকায়। বন্ধু-বান্ধব, এলাকাবাসীর কাছে তিনি রমজান (ডাকনাম) নামে পরিচিত। সুলতান তালুকদারের চার সন্তান। তাদের মধ্যে সেলিম ছিলেন মেজো এবং তিন বোনের একমাত্র ভাই। ছেলেবেলা থেকেই নম্র, ভদ্র, হাসমুখ হিসেবে পরিচিত এলাকায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন, পরিবারের সদস্যদেরও নামাজের ব্যপারে তাগাদা দিতেন।বিজিএমই ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে দুই বছর আগে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে নারায়ণগঞ্জের মেট্রো নিটিং এন্ড ডায়িং মিলস লিমিটেড-এর সহকারী মার্চেন্ডাইজার পদে চাকরি করতেন। ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট বিয়ে করেন সুমি আক্তারকে। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ১৬ বছরের নির্যাতন, নিষ্পেষণে পিষ্ট বাংলাদেশের মানুষ ভুলতে বসেছিল অধিকার কেউ থালায় সাজিয়ে দেয়না, আদায় করে নিতে হয়। স্বৈরাচারী হাসিনার দুঃশাসনকেই তাদের ভাগ্যের লিখন মেনে নিয়েছিল। “এই দেশে আর কিছু হবেনা”- এই বাক্যই ছিলো প্রবীণদের দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু দেশের ছাত্রসমাজ এই দীর্ঘশ্বাসকে প্রত্যাখান করেছিল। যে দেশের বিদ্রোহী কবি নজরুল, রেঁনেসা কবি ফররুখ, আধুনিকতায় লালিত হয় মীর আব্দুশ শাকুর আল মাহমুদ এবং আধ্যাত্মিকতায় মল্লিক সে দেশের তরুণ সমাজকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। তথাকথিত “চেতনার বড়িতে” অরুচি হয় দ্রুত। উন্নয়নের ফানুস তাদের হৃদয়ে কোন ভাবাবেগ তৈরী করেনা। তারা দ্রুতই বুঝতে পারে তাদের দেশের নীতিনির্ধারনী পরিষদ মিথ্যাবাদী, ভাঁড়, নিম্নবুদ্ধিমত্মা, মনোরঞ্জনকারী গায়ক-নর্তকীদের এক মহামিলন। যারা দেশকে এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। যাদেরকে এখনই থামানো না গেলে সামনে গভীর পতন ছাড়া আর কিছুই নেই এদেশের ভাগ্যে। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলে সময়ের ব্যবধানে সমগ্র জাতি এতে সাড়া দেয়। সারাদেশে ছাত্র জনতার ঢল নামে। মুখে মুখে উচ্চারিত হয় স্বৈরাচারের পতনধ্বনি। সে আন্দোলনে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে শুরু থেকেই যোগ দেন সেলিম তালুকদার। ১৮ জুলাই খুব সকালে সেলিম তার ইউনিভার্সিটির পুরনো আইডি কার্ডটি বের করেন। তার মা জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছু বলেননি। পরে মা বুঝতে পারেন তিনি আন্দোলনে যাচ্ছেন। তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করেন মা। উত্তরে সেলিম বলেন, ‘মানুষের ছেলেরা শহীদ হচ্ছে, তোমার ছেলে আঁচলে বাঁইধা রাখবা নাকি! দেখছো রংপুরের ছেলেটা ক্যামনে বুক আগাই দিয়া শহীদ হইছে, দোয়া করো যেন শহীদ হই’- এ কথা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সেলিনা বেগম। আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য পরিবারের লোকেরা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে। তার স্ত্রী বারবার বাধা দেয়। সে স্ত্রী, বাবা ও মাকে জানায়- আমরা যদি আন্দোলন না করি তাহলে এই স্বৈরাচারের পতন হবে? সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর অসুস্থতা ফেলেই চলে যান আন্দোলনে। আন্দোলন যার রক্তে আগুন জ্বালিয়েছে, শাহাদাতের সুধা পানের লক্ষ্যে তৃষিত যে হৃদয়, তাকে আটকিয়ে রাখার সাধ্য কার !! সেইদিন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাট ডাউন কর্মসূচি। আর সেইদিন মেরুল বাড্ডা থেকে রামপুরা পর্যন্ত সমস্ত রাজপথ ছিল ছাত্র জনতার দখলে। আন্দোলনের মিছিলে প্রথম সারিতে ছিলেন শহীদ সেলিম। ১৮ জুলাই বেলা ১১টার দিকে তিনি ফেসবুকে একের পর এক সহিংসতার ভিডিও প্রকাশ করতে থাকেন। ছাত্রজনতার সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের থেমে থেমে সংঘর্ষ হতে থাকে। একপর্যায়ে মিছিল ভঙ্গ করতে খুনি হাসিনার পুলিশ ও হেলমেট বাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি করতে থাকে। দুপুর ১১ টার দিকে এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে সেলিম আহত হন, শর্টগান থেকে ছোড়া অসংখ্য স্প্রিন্টার আঘাত করে তাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সেলিম। তার শরীরের রক্তে রাজপথ লাল হয়ে যায়। বেলা ১টার দিকে সেলিমের ফোন থেকে অপরিচিত একজন ফোন করে তার পরিবারকে জানান, সেলিম গুলিবিদ্ধ এবং ফরাজি হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তার পর থেকে বন্ধ পাওয়া যায় ফোন। দিশেহারা মা ও তার ছোট বোন পাগলের মতো ছুটে যান হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে না পেয়ে ছুটে যান মুগদা মেডিকেলে। দেখতে পান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সেলিম। ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে তার শরীর ও মাথা। গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় তাকে। অবস্থার আরো অবনতি হলে ধানমন্ডি পপুলার হসপিটালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এক্স-রে ও সিটিস্ক্যানে সেলিমের মাথায় ১৮টি, বুক ও পিঠে ৫৭টি ছররা গুলি পাওয়া যায়। শরীরে অসংখ্য ক্ষত নিয়ে টানা ১৩ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ১ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। আহত অবস্থায় প্রশাসনিক হয়রানির ভয়ে অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি নিতেও অস্বীকৃতি জানায়। মৃত্যুর পর সনদ নিতে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে সেলিমের পরিবার। স্ত্রী সুমি বলেন, ১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর সনদ নিতে গিয়ে পুলিশ সকাল থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত লাশ আটক রাখে। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মর্মে সেলিমের বাবার কাছ থেকে লিখিত নেয়। একপর্যায়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেলিমের লাশ নিয়ে আসতে হয়। এদিন বাড্ডার লিংক রোডে কুমিল্লাপাড়া এলাকায় (ভাড়া বাসা) প্রথম জানাজা শেষে রাতেই গ্রামের বাড়ি নলছিটি উপজেলার উদ্দেশে রওনা হয় তার পরিবার। ২ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নিজ বাড়ির মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সেলিম তালুকদার। সেলিম তালুকদারের মৃত্যুর তিনদিন পর কুলখানির আয়োজন করা হয়। সেদিনই ছিল তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয় পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন সেলিম। তখনো জানতেন না তিনি বাবা হতে যাচ্ছেন। কুলখানি অনুষ্ঠানের দিন সেলিমের স্ত্রী অসুস্থ হন। ৫ আগস্ট চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানা যায়, সুমি আক্তার চার সপ্তাহ ছয়দিনের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচদিনের মাথায় মা হওয়ার খবরে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন সুমি আক্তার। শুধু সেলিম তালুকদারের মৃত্যু শোকই নয়, অনাগত এক শিশুর পিতৃহীনতা, সুমি আক্তার আর সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কর্মক্ষমতা হারানো বাবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেসন্তান হারানো, এমন আকস্মিক বিপদে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই যেন জীবন্মৃত। পরিবারের বর্তমান অবস্থা পড়াশোনা শেষ করে সেলিম হাল ধরেন পরিবারের। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে সহকারী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেসন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা। অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূর ভবিষ্যৎ, পরিবারে একমাত্র আয়ের উৎস সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব হাতে ঢাকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেলিমের পরিবার। বাবা সুলতান তালুকদার কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক বছর আগে। পেশা হিসেবে নিজের রেন্ট-এ-কারে একসময় যাত্রী পরিবহন করতেন। ৬৬ বছর বয়সে গাড়ি চালানোর কাজে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হাত-পা ফুলে যায় তার। কর্মে ফেরাও এখন অসম্ভব। এ পরিবারে হাল ধরার মতো নেই আর কেউ। কীভাবে সংসার চলবে, সেলিমের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে যেনে এক অনিশ্চিত জীবন পার করছে সেলিমের পরিবার। সুমি বলেন, ‘আমি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমাকে সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিলে অনাগত সন্তানকে নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকাতে পারতাম। আমি আমার স্বামী হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার চাই।’ শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের বক্তব্য বোন নাসরিন আক্তার সুমা বলেন, আমার ভাই আমাদের পড়াশুনার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাদেরকে নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিতেন। কখনো ভাই খারাপ কাজ করতেন না। আল্লাহ ভাইকে এত তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। তার কথা মনে পড়লেই অনেক কষ্ট লাগে। আল্লাহ ভাইকে জান্নাত নসিব করুন। সেলিমের বাবা সুলতান তালুকদার বলেন, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। অনাগত সন্তানের মাঝে ওর স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। এখন সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমার ছেলে যেন শহীদের তালিকায় স্থান পায়। সেলিমের শ্বশুর মতিউর রহমান বলেন, আমার মেয়েটা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেল। গর্ভে সেলিমের অনাগত সন্তান। আমার মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এখন ওর যদি কোনো কর্মসংস্থান হয়, তবে অনাগত সন্তানকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবে। প্রস্তাবনা ১. শহীদের চিকিৎসা বাবদ তার পরিবার প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা ঋণ করেছে। ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ২. তার বিধবা স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ৩. বোনের পড়াশোনা ও বিয়ের বিষয়ে সহযোগিতা করা যেতে পারে। ৪. অসুস্থ পিতা মাতার জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ নাম : মো: সেলিম তালুকদার পেশা : চাকরিজীবি জন্ম তারিখ : ২৫-০১-১৯৯৫ পিতা : সুলতান তালুকদার, মাতা: সেলিনা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ মল্লিকপুর, ইউনিয়ন: নলছিটি পৌরসভা, থানা: নলছিটি, জেলা: ঝালকাঠি ঘটনার স্থান : ব্রাক ইউনিভার্সিটি, মেরুল বাড্ডা আহত হওয়ার সময়কাল : ১৮-০৭-২০২৪, সকাল ১১.৩০ শাহাদাতের সময়কাল : ৩১-০৭-২০২৪ আঘাতের ধরন : ছররা গুলি আক্রমণকারী : পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : পারিবারিক কবরস্থান, নলছিটি শাহাদতের দিন সেলিমের স্ত্রী সুমি আক্তার ৪ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন