জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ১৯৮৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : গাড়ি চালক, শাহাদাতের স্থান : বাড্ডা, শাহজাদপুর, ঢাকা
২৪ এর মুক্তিকামী শহীদ কামাল হোসেন এর ডাকনাম সবুজ (৩৮)। বাড়ি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বালকদিয়া গ্রামে। জনয়িতা জনাব মুনসুর হাওলাদার (৭০) ও জননী মৃত মাহমুদা বেগমের একমাত্র শহীদ সন্তান তিনি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের গাড়ি চালক ছিলেন এই তেজস্বী বীর। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজের একাকীত্ব জীবন ঘুচাতে সাদিয়া বেগম রাণীর (৩২) সাথে রঙিন জীবনে বাঁধা পড়েছিলেন কামাল। একেএকে দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় তিন সন্তান। ছেলেদ্বয় সামিউল ইসলাম (১৩) ও আবদুল্লাহ (৫)। একমাত্র মেয়ে ইসতিয়াক জাহান (৩)। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও শহীদ ছিলেন দায়িত্ব পালনে অনড়। আর্থিক অসঙ্গতি থাকলেও সততা ও পরিশ্রমের বলয়ে নিজ পরিবারকে নিয়ে মফস্বল ছেড়ে ঝালকাঠি শহরে ভাড়া বাসায় সংসার পেতেছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন সন্তানেরা একদিন মানুষের মত মানুষ হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। দিন-রাত পরিশ্রমের ফলে শারীরিক ভাবে অসুস্থতা অনুভব করলেও তাঁকে থামানো যায়নি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবে তিনিই ছিলেন একমাত্র ভরসা। দেশের স্বাধীনতা ফেরাতে পরিবারের কথা না ভেবে নিজের জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে নিজেকে ঠাই করে নিয়েছেন শহীদ কামাল হোসেন সবুজ। ঘাতকদের সাথে লড়াইয়ের দিন গুলো কেমন ছিল দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। যার ফলে নতুন এক সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে। আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, তার একটি গতিমুখ ঠিক করে দিয়েছে এই আন্দোলন। এই গতিমুখের সঙ্গে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশও ঘটেছে। আপামর জনতা এক হয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলে সোচ্চার হয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটায়। আন্দোলনের একমাত্র কারণ ছিল দেশের মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায়। প্রতিষ্ঠিত হয় জনমতের স্বাধীন চেতনা। প্রভাবমুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দেশের জনগণ একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকে ক্ষমতাসীনরা যেন ভয় দেখাতে না পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় থাকে, ক্ষমতার ভারসাম্য হয়, ধর্ম-মতের নাগরিকগণ সকলে নিজেদের অধিকার যেন ফিরে পায়! জুলাই ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক ক্রান্তিকাল লগ্ন। সারাদেশে ছাত্র-জনতা সরকারী চাকরির বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে একযোগে আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনগোষ্ঠী। আন্দোলন দমাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করে। গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকে ঘাতক পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শাহাদত বরণ করেন। শিক্ষার্থীদের সামনে হাসতে হাসতে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী দেশের চরম শত্রু, স্বৈরাচারী, খুনি, নরখাদক হাসিনার লেলিয়ে দেয়া হিংস্র পুলিশ বাহিনী। ফলে রাজধানী সহ সারাদেশে ছাত্র-জনতা দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বৈরাচারের দোসররা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়। সেদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাত-পা বেঁধে ফেলার পরও আন্দোলন থেমে থাকে না। ঊর্ধ্বগতিতে আন্দোলন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আন্দোলন দীর্ঘায়িত করতে ঢাল হয়ে দাড়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যেন সংগ্রাম নেতৃত্বের ভার তারা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিল সেদিন। আন্দোলন নতুন করে গতি ফিরে পায়। সরকারের রক্তচক্ষুকে অপেক্ষা করে ময়দানে সরব হয়ে ওঠে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আপামর জনতা। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে বিভিন্ন কর্মসূচি তারা বাস্তবায়ন করে। যেভাবে তিনি শহীদ হন ২০ জুলাই ২০২৪ শনিবার, সকাল নয় ঘটিকা। রাজধানীর বাড্ডার শাহজাদপুর এলাকায় নাস্তা খেতে বের হয় কামাল হোসেন সবুজ। ইচ্ছে ছিল নাস্তা শেষে কর্মস্থলে ফিরবেন। পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন খবরাখবর দেখে আন্দোলনে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে পোষণ করেন তিনি। তবে পেশায় গাড়িচালক হওয়ায় সময় বের করতে পারেন না। হঠাৎ নাস্তা করা কালীন ঘাতক পুলিশের একটি গুলি তাঁর কপালে এসে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তে মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে আসে কামালের। পথচারীরা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। স্বৈরাচারের পেটুয়া বাহিনী হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাঁধা দেয়। হাসপাতাল কর্মীরা ভঁয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। চিকিৎসার অভাবে ধীরেধীরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন শহীদ কামাল হোসেন সবুজ। শহীদের লাশ পরদিন ২১ জুলাই রবিবার ঝালকাঠি সদর উপজেলার আগরবাড়ি এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে দাফন করা হয়। নিউজ লিংক https://sokalerkhobor24.com/news/54710/ https://www.somoynews.tv/news/2024-07-25/0FYLUzDx https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/v0c2oxpkjyf https://www.kalbela.com/country-news/107144 পরিবারের অভিমত শহীদ স্ত্রী সাদিয়া বেগম রাণী (৩২) বলেন- ‘এই তিন ছেলে মেয়ে এখন এতিম হয়ে গেল! আমি ওদের নিয়ে কোথায় দাঁড়াব, এখন কে ওদের দেখবে? ‘সংসার চালানোর মতো কেউ আর রইল না। বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে ভেবে উঠেতে পারছি না।’ জনাব রিপন বলেন, ‘আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিরা পিতাহারা হয়ে গেল। অল্প বয়সে বোনটি বিধবা হয়ে গেল। ওদের কান্না আর সহ্য করতে পারছি না। আমি এর বিচার চাই।’ শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদের পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের ভরণপোষণ, এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য নিজের পৈতৃক জমিতে বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে আর্থিক টানাপড়েনে পড়েন কামাল হোসেন ও তাঁর পরিবার। একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে শহীদ পরিবারটি এখন নিঃস্ব। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। শহীদের প্রস্থানের পর ভাড়া বাসা ছেড়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা। প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারে মাসিক ও এককালীন সহায়তা করা যেতে পারে। ২. শহীদ সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে। ৩. শহীদ স্ত্রীকে কর্মসংস্থান করে দেয়া যেতে পারে। একনজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : মো: কামাল হোসেন, বয়স: ৩৮, পেশা: গাড়ি চালক পিতা : মো: মুনসুর হাওলাদার বয়স: ৭০, অসুস্থ মাতা : মৃত মাহমুদা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : ঝালকাঠি, সদর উপজেলা, বিনয়কাঠি ইউনিয়ন, বালকদিয়া গ্রাম বর্তমান ঠিকানা : একই শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ২০ জুলাই ২০২৪, বাড্ডা, শাহজাদপুর, ঢাকা যাদের আঘাতে শহীদ : পুলিশের গুলি শহীদের কবরস্থান : ঝালকাঠি সদর উপজেলার আগরবাড়ি (শ্বশুরবাড়ি এলাকায়) পরিবার : ১. স্ত্রী: মোসা: সাদিয়া বেগম রাণী, বয়স: ৩২, পেশা: গৃহিণী, শিক্ষাগত যোগ্যতা: ১০ম শ্রেণি : ২. ছেলে: মো: সামিউল ইসলাম, বয়স: ১৩, পেশা: ছাত্র, প্রতিষ্ঠান: ঝালকাঠি সরকারী বিদ্যালয়, শ্রেণি: সপ্তম : ৩. ছেলে: মো: আবদুল্লাহ, বয়স: ০৫, পেশা: ছাত্র, স্থানীয় মাদ্রাসায় হিফজুল কোরআন বিবাগে অধ্যয়নরত : ৪. মেয়ে: মোসা: ইসতিয়াক জাহান, বয়স: ০৩