Image of মো: নুর হোসেন

নাম: মো: নুর হোসেন

জন্ম তারিখ: ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: রাজমিস্ত্রি শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

শহীদের জীবনী

"পরিবারের একমাত্র ভরসা ছিলেন সেও চলে গেলেন রবের তরে" শহীদ পরিচিতি শহীদ নুর হোসেন ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এসএসসি পাশ করার পর তিনি ঢাকার একটি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। পড়শোনার পাশাপাশি তিনি নিজেকে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত রাখতেন। তার পিতা জনাব আব্দুর রশিদের আকস্মিক মৃত্যুতে তার জীবনে নেমে আসে এক কালো মেঘের ছায়া। পিতাকে হারিয়ে শহীদ নুর হোসেন এতিম হয়ে যান। মৃত্যুকালে জনাব আব্দুর রশিদ এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান। অভাবের সংসারে জনাব আব্দুর রশিদের আয়েই ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার সকল খরচ চলত। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে শহীদ নুর হোসেনের মাতা মোছাঃ নুরন্নাহার চিনু সন্তান-সন্ততি নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সংসারের দায়-দায়িত্ব শহীদ নুর হোসেনের উপর অর্পিত হয়। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে নিজের পড়াশোনার দিকে আর মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। পড়ালেখা করে বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন তার কুড়িতেই বিনষ্ট হয়ে যায়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেন। দিন হাজিরা কাজ করে যা আয় হত তা দিয়েই তাদের তিন সদস্যের সংসার চলত। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের ভরণপোষণের খরচ বহন করতে তাকে প্রাণপন পরিশ্রম করতে হত। পরিবারের অভিভাবককে হারিয়ে নিজেই অবতীর্ণ হন অভিভাবকের ভূমিকায়। ছোট ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হয় শহীদ নুর হোসেন কে। তার ছোট ভাই মো: আবির হোসেন পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে। শহীদ নুর হোসেন অল্প বয়সেই পরিবারের পছন্দের এক মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের ৬ মাসের মধ্যেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। শহীদ নুর হোসেন ছাত্র অবস্থা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সবসময় সমাজের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করতেন। বাস্তবতার কারণে নিজে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারলেও তিনি সবসময় ছাত্রদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে, এই অকুতোভয় সাহসী যুবক নিজের জীবটাও বিসর্জন দেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক পুলিশের নৃশং গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। যেভাবে নুর হোসেন শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করলেন ছাত্রদের কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনে আওয়ামী নরপিশাচদের হামলায় মুহূর্তেই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রুপ নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। দেশের মুক্তিকামী মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। চতুর্দিক থেকে মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই সাধারণ ছাত্ররা নায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে শাহাবাগ ও ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের নায্য দাবী আদায়ের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। ছাত্রদের দমন করতে সরকার তার দলীয় পোষা গোণ্ডা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানের নির্দেশে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী লোহার রড, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, রামদা, চাপাতি ও দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের পোষা গোণ্ডা এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাড়া করে আনা গোণ্ডাদের নিয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের হামলার হাত থেকে নিরস্ত্র বোনদেরও রক্ষা মিলেনা। রাস্তায় আটকিয়ে বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে তাদেরকে নির্বিচারে পিটায়ে রক্তাক্ত করে। রাতে স্বৈরশাসক খুনি হাসিনা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেয়। মুহূর্তেই ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মধ্যরাতে ঢাবির হলগুলো থেকে ভেসে আসে, “তুমি কে আমি কে?-রাজাকার, রাজাকার।” মুহূর্তেই ৭১’র ঘৃণিত শব্দ ২৪ এ এসে মুক্তির স্লোগানে পরিণত হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের মেয়েরা মধ্য রাতে রাজপথে নেমে আসে। ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একযোগে প্রতিবাদ জানায়। এরপর থেকে আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। ক্রমেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। হুমকি, গুম-খুন, হত্যা, গ্রেফতার, জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শহীদ নুর হোসেন ছিলেন এই আন্দোলনের একজন সম্মুখ যোদ্ধা। বৈষম্যবিরোধী স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র-জনতা লং মার্চ টু গণভবন ঘোষণা করে। সারাদেশ থেকে মুক্তিকামী জনতা গণভবনের দিকে রওনা করে। স্বৈরাচারের ঘাতক-দালাল আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও বিপথগামী পুলিশ সদস্যরা একত্রিতভাবে ছাত্র-জনতার উপর টিয়ারশেল, ছররা বুলেট, গ্রেনেড, বোমা, সাজোয়াযান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে থাকে। অসংখ্য মানুষ হামলায় আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও অনেকে। তবু ছাত্র-জনতা জুলুমের সাথে আপোষ করেন না। জালিমের বুলেটকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শহীদ নুর হোসেনও ছিলেন এই আন্দোলনের এক অকুতোভয় সাহসী যোদ্ধা। ছাত্র-জনতার সাথে সেদিন তিনিও যুক্ত হয়েছিলেন। স্বৈরাচারের ঘাতকদের সাথে প্রাণপনে যুদ্ধ করেন। শাহাদাত বরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এক সাহসী যুবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পড়ে স্বৈরাচার সরকার। অবস্থা বেগতিক দেখে স্বৈরাচার খুনি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ৫ আগস্ট ২০২৪ বেলা এগারোটার দিকে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। এরপর খুনি শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার যোগে ভারতে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনার পালানোর খবর ছড়িয়ে পরলে সারা দেশে আনন্দ মিছিল বের হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে জনতা আনন্দ মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে আসেন। কিন্তু স্বৈরাচারের ঘাতক দালাল সন্ত্রাসীরা তাতেও আক্রমণ করে। শহীদ নুর হোসেন আনন্দ মিছিল নিয়ে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। যখন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আসেন তখনই তিনি আক্রমণের শিকার হন। সেখানে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। পুলিশের সাথে যুক্ত হয় আওয়ামী সন্ত্রাসীর দল। এক পর্যায়ে শহীদ নুর হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকটি বুলেট এসে তার বুকে লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তিনি সেখানেই শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করেন। ছাত্ররা অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। তাকে স্থানীয় ডেলটা হেলথ কেয়ার যাত্রাবাড়ী লিমিটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, তিনি আগেই মারা গিয়েছেন। তার মৃত্যুতে পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব সকলেই শোকাহত হয়ে পড়ে। শহীদ সম্পর্কে তার নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য শহীদ নুর হোসেনের বন্ধু বোরহান উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪-১৫ সেশনের ছাত্র। তিনি বলেন, “মো: নুর হোসেন আমার স্কুল বন্ধু। সে অনেক ভালো মানুষ ছিল। সবসময় সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় কাজের শেষে আন্দোলন নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সে গভীরভাবে চিন্তিত ছিল। ১৮ জুলাই থেকে নূর হোসেন নিয়মিত মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করছিলেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বিজয় মিছিলে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। অনেক মানুষ সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে শহীদ নুর হোসেনও ছিলেন। শহীদ নুর হোসেন চিরকাল আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন। আমি আমার বন্ধু হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই এবং তার পরিবারের পাশে থেকে সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।” পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ মো: নুর হোসেন একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তার পিতা জনাব মো: আব্দুর রশিদ ১০ বছর আগে মারা যান। শহীদ নুর হোসেনের পরিবারের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নেই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। শহীদ নুর হোসেন রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন। তার একক আয়েই সংসার চলত। তার পরিবার যাত্রাবাড়ীতে একটি ভাড়া বাসায় থাকে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩ জন। ছেলেকে হারিয়ে শহীদ নুর হোসেনের মা দিশেহারা। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: নুর হোসেন, পেশা: রাজমিস্ত্রি জন্ম তারিখ : ০৬/০৯/১৯৯৬ জন্ম স্থান : ঢাকা পিতা : জনাব মো: আব্দুর রশিদ (মৃত) মাতা : নুরন্নাহার চিনু, পেশা: গৃহিণী আহত হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ৫ আগস্ট ২০২৪, যাত্রাবাড়ী দাফন : মাতুয়াইল কবরস্থান স্থায়ী ও বতর্মান ঠিকানা : দনিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: নুর হোসেন
Image of মো: নুর হোসেন
Image of মো: নুর হোসেন
Image of মো: নুর হোসেন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আরিফ

মেহেরুন্নেসা তানহা

মো: শাহাবুদ্দিন

নাসির হোসেন

মো: ইসমাইল

মো: সুমন সিকদার

জাহিদুজ্জামান তানভীন

মমিন ইসলাম

আব্দুল জব্বার

মো: রিয়াজ

মো: জাকির হোসেন

মো: সবুজ

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo