জন্ম তারিখ: ২ মার্চ, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা :প্রাণ কোম্পানিতে তিনি চাকুরী করতেন, শাহাদাতের স্থান :যাত্রাবাড়ী থানার সামনে
মোঃ রাকিব নব্য স্বাধীন দেশের বীর সৈনিক ছিলেন। তিনি ২ মার্চ ১৯৯৮ সালে পিতা আবুল হাশেম মোল্লা ও মাতা কোহিনুর বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম নেন। তার বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন থানার পূর্ব চর মাদ্রাজ গ্রামে। মো: রাকিবের জন্মতে বাবা আবুল হাশেম মোল্লা ও মাতা কহিনুর বেগমের সংসারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মাতা কোহিনুর বেগম ছেলেকে তিলে তিলে জীবনের সকল কষ্টকে হাসি মুখে মেনে নিয়ে সন্তানকে বড় করেন। পরিবার অসচ্ছল থাকায় লেখাপড়ায় তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে মো: রাকিব অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও পরোপকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাদের বাবা-মা ভাইসহ পরিবারে চারজন সদস্য ছিল। সমাজে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সরকারের ফ্যাসিস্ট পুলিশ বাহিনী ও কুখ্যাত সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের হাতে তাকে জীবন দিতে হলো। তিনি ছিলেন বাবার আদর্শ ও সমাজের সর্বস্তরে মানুষের ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরুন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয় । আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। শহীদ সংক্রান্ত ঘটনার বর্ণনা ছাত্রলীগ দেশব্যাপী কুখ্যাত ও এক সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম। ভিন্নমতের ছাত্রদের দমন পীড়ন, নির্যাতন দিনদুপুরে মানুষ মেরে খুন করার নজির রয়েছে। কোন ছাত্র সংগঠন এত ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, নির্দয় ও নির্মম হতে পারে তা কারো জানা নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মো: রাকিব ছিলেন একজন জীবন বাজি রাখা সৈনিক। ৫ আগস্ট ছিল তার জন্য অভিশপ্ত দিন। এ দিনে দুপুরের খাবার খেয়ে তিনি অন্যান্য ছাত্রদের সংঘটিত করে আন্দোলনের যোগদান করেন। শহর মিছিলের জনপদে পরিণত হয়। তিনি সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া সে দিনটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা চলো কর্মসূচি। কর্মসূচির ডাকে সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। সেই ছাত্র জনতার সাথে তিনি ও তার ছোট ভাই যুক্ত হন। ৫ তারিখ দুইটার মধ্যে হাসিনা সরকার পদত্যাগ করলে ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল শুরু করে। পুলিশ সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে মো: রাকিবের বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। ছোট ভাই বেঁচে গেলেও বড় ভাই রাকিব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যাত্রাবাড়ী থানার সামনেই চিরকালের জন্য বিদায় নিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হওয়ার স্বপ্ন ও তার আত্মত্যাগ এলাকার সকল স্তরের মানুষের কাছে স্মরণীয় করেছে। আমরা দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা তাকে শহীদী মর্যাদা দান করুন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর অনুভূতি মো: রাকিব ছোটবেলা থেকেই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, সে এলাকার জন্য গর্ব করার মত ছেলে ছিল। ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও বাবা-মায়ের বাধ্যগত নেক সন্তান ছিলেন। সে সর্বদা গরিব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। অন্য একজন প্রতিবেশী বলেন, আমার চোখে এমন ভদ্র ছেলে আর কাউকে দেখি নাই। কারো সাথে বেয়াদবী করেছে এটা আমার জানা নেই। সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সবাইকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার একমাত্র ছোট ভাই বলেন, আমার ভাই সহজ সরল ও সুন্দর মনের অধিকারী ছিলেন। শহীদ সম্পর্কে মা কোহিনুর বেগম বলেন, বছর খানেক আগে বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর থেকে পরিবারের সম্পূর্ণ হাল ধরেন আমার ছেলে মো: রাকিব। কিন্তু রাকিবের মৃত্যুতে আমার পরিবারে অচল অবস্থা দেখা দিয়েছে। আমি এই হত্যার বিচার চাই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা মোঃ রাকিবের পরিবার ছিল আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও মধ্যবিত্ত। বাবা আবুল হোসেন মোল্লা যা উপার্জন করতেন তা মো: রাকিব ও তার একমাত্র ছোট ভাইয়ের পিছনে খরচ হয়ে যেত। সংসারে ছেলে একদিন দায়িত্ব নিবে এই প্রত্যাশা নিয়ে সময় অতিবাহিত করতেন। ইতোমধ্যে বাবা মারা যান। পরিবারের পুরো দায়িত্ব চলে আসে মো: রাকিবের উপর। তিনি প্রাণ কোম্পানিতে চাকুরীও নিয়েছিলেন। মা জননী ও ছোট ভাইকে নিয়ে ভালোই চলছিল। মা বলেন, হৃদয়ের ধন এভাবে চলে যাবে তিনি কোনদিন ভাবতেও পারেননি। মো: রাকিবের পরিবারটা একেবারে অসহায় হয়ে গেল। বর্তমানে পরিবারের উপার্জনের আর কেউ রইল না। অসহায় মা তার ছোট সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এক নজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: রাকিব জন্ম : ০২/০৩/১৯৯৮ পিতা : আবুল হাশেম মোল্লা মাতা : কহিনুর বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পূর্ব চর মাদ্রাজ, ইউনিয়ন: চর মাদ্রাজ, থানা: চর ফ্যাশন, জেলা: ভোলা পেশা : প্রাণ কোম্পানিতে তিনি চাকুরী করতেন ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আহত হওয়ার সময়কাল : ০৫/০৮/২০২৪ বিকাল ৩টা শাহাদাতে সময়কাল : ০৫/০৮/২০২৪ বিকাল ৩টা আাঘাতের ধরণ : শরীরে গুলি লাগে আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী হাসিনার ঘাতক পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : পূর্ব মাদ্রাজ পারিবারিক কবরস্থান প্রস্তাবনা: ১. ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ যোগানে সহযোগীতা করা যেতে পারে ২. এককালীন অর্থ দেওয়া যেতে পারে