জন্ম তারিখ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : কয়েল ফ্যাক্টরির শ্রমিক, শাহাদাতের স্থান : মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল
“কুরআন যে ধারণ করে তাঁর নিজ অন্তরে, সে ফিরবেই বারেবারে শহীদি কোন প্রান্তরে” শহীদ ওমর ফারুক ভোলা জেলার লালমোহন থানার অন্তর্ভুক্ত চরভূতা ইউনিয়নের হরিগঞ্জ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর পিতা মো: ফয়েজুল্লাহ ও মাতা হামিদা বেগম। ছোটবেলাতেই স্থানীয় এক মক্তবে হাতেখড়ি তার। প্রবল মেধাবী ওমর ফারুক অল্প দিনেই শেষ করলো, কুরআনের প্রায় ২০ পারা হিফজ। শৈশব ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য: দ্বীপাঞ্চল ভোলার ছবির মতো সুন্দর গ্রাম হরিগঞ্জে কেটেছে তাঁর শৈশব। ছোট থেকেই নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন তিনি। আর তাই বড়দের স্নেহ ও ছোটদের ভালোবাসার পাত্র ছিলেন তিনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও শহীদ ওমর ফারুক ছিল নির্লোভ, কষ্টসহিষ্ণু৷ বড় ভাই আল-ইমরান ও আরেক সহোদর বোন হাফসার সাথে কেটেছে তাঁর শৈশব। তাঁর আচরণে পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন ও সহকর্মীরা খুবই সন্তুষ্ট ছিল। বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বাবাকে সহযোগিতা আর বড় ভাইয়ের এবং ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ মেটাতে সে নিজেই পরিবারের হাল ধরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কালক্ষেপণ করেনি। তাই, একটি কয়েল ফ্যাক্টরীতে নিজে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সহযোগিতা করতে থাকেন তার বাবা ও পরিবারটিকে। পরোপকারী মানুষ হিসেবে এলাকাতেও তার সুনাম পাওয়া যায় মানুষের মুখে মুখে। শহীদের পারিবারিক অবস্থা শহীদ ওমর ফারুকের বাবা একজন নিরাপত্তা প্রহরী। আর শহীদ নিজে একটি কয়েল ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে চাকুরি করতেন। ওমর ফারুকের এক ভাই ও দুই বোন আছে। বাবা-মা বেঁচে আছেন। গ্রামে বসতভিটার ১৫ শতাংশ জমিটুকুই তাদের একমাত্র সম্বল। এছাড়া তাদের আর কোন জমিজমা নেই। ঢাকার রায়েরবাগ টিনের ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। তার বোন হাফসা বেগম (২০) এর অল্প বয়সে বিয়ে হলেও আবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। বড় ভাই আল ইমরান (২৫) (শিক্ষার্থী, ফাজিল ৩য় বর্ষ) এবং ছোট বোন আফসানা (১৩) (শিক্ষার্থী, ৮ম শ্রেণি)। দুজনেই ভোলা জেলার লালমোহন ইসলামীয়া কামিল মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত। এই পুরো পরিবারটি চলতো শহীদের কয়েল ফ্যাক্টরিতে শ্রম দেওয়া অর্থ এবং তার বাবার নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করে প্রাপ্ত অল্প কিছু অর্থ দিয়েই। ওমর ফারুক থেকে শহীদ ওমর ফারুক হয়ে ওঠার গল্প: দেশের সর্বত্রই তখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন আর স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী গুলোর প্রতিরোধ। রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল এই আন্দোলনের প্রথম থেকেই 'রেডজোন' এরিয়া। ক্রমাগত 'বাংলা ব্লকেড', 'কমপ্লিট শাটডাউন' বিভিন্ন নামে আন্দোলনের গতি দিনদিন বাড়তে থাকে। স্বৈরাচার সরকারের প্রশাসন ও দলীয় ক্যাডার কর্তৃক প্রতিনিয়তিই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ধরপাকড়, গুলিবর্ষণ, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা ইত্যাদি তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ১৯ জুলাই ২০২৪ ইংরেজি, রোজ-শুক্রবার চলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচী। অপরদিকে অবৈধ খুনি সরকার কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়েছে। কিন্তু, সারাদেশে ছাত্র-জনতা কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা অবৈধ সরকারের প্রশাসন কোনভাবেই দমাতে পারছিল না। সেদিন যাত্রাবাড়ী এলাকার দনিয়া কলেজের সামনে সারাদিন আন্দোলনের সাথে রাজপথে ছিল শহীদ ওমর ফারুক। পুলিশ হামলা, টিয়ারগ্যাস আর গুলি উপেক্ষা করেও মাঠে টিকে ছিলেন তিনি। পাশাপাশি অন্দোলনে অংশ নেওয়া অন্য সবাইকেও বারবার সতর্ক করছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে, সন্ধ্যা নামার সাথে বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার উপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। অন্যদিকে পুলিশও তখন বেশ মারমুখী। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা নিখুঁত নিশানার মাধ্যমে গুলি করছিল কয়েক মিটার সামনে থাকা নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর। তবুও দমানো গেল না, ছাত্র-জনতার দ্রোহ। গুলিবিদ্ধ আর আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেও অন্য সবাই থেকে যাচ্ছিলো রাজপথেই। এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তে কয়েকটি বুলেট এসে শহীদ ওমর ফারুকের বুক ঝাঁজরা করে দিলো। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন শহীদ ওমর ফারুককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যান। ফুসফুস বুলেটে আক্রান্ত হওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ২ আগষ্ট' ২০২৪ রাত্রী ৩টা বেজে মিনিটের সময় ইন্তেকাল করেন। শহীদ সম্পর্কে সহোদর ভাইয়ের স্মৃতিচারণ শহীদ বড় ভাই আল ইমরানের ভাষ্যমতে, "শহীদ ওমর ফারুকের পড়াশোনায় এগোতে পারেনি খুব বেশি তবে, ন্যায়-অন্যায় কে বিবেচনা করার ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার ও স্বক্রীয় ভূমিকা পালন করতে চেষ্টা করত সবসময়। ছোটবেলায় তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলে ২০ পারা কুরআনের হেফজ সম্পন্ন করে। তেমনি এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর ১৬ জুলাই স্বৈরাচার সরকারের একপ্রকার দমনপীড়ন অবস্থা দেখে নিজেই রাজপথে নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক পরদিন থেকেই পুরোপুরি সক্রিয় থেকে প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে শহীদ ওমর ফারুক। সে নিয়মতি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তো। একজন ধর্মপ্রাণ, সহজ সরল, পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিল শহীদ ওমর ফারুক। স্থানীয় আলেম-ওলামায়ে কেরামের সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল।" একনজরে শহীদ ওমর ফারুক শহীদের পূর্ণনাম : ওমর ফারুক জন্ম তারিখ : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ পেশা বা পদবী : কয়েল ফ্যাক্টরির শ্রমিক পিতার নাম : মোঃ ফয়জুল্লাহ পিতার পেশা ও বয়স : সিকিউরিটি গার্ড, ৬০ বছর মাতার নাম : হামিদা বেগম মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিনী, ৩৭ বছর পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন পরিবারের মাসিক আয় : ১৫০০০ ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য : স্থায়ী ঠিকানা : হরিগঞ্জ, ইউনিয়ন: চড়ভুতা, উপজেলা: লালমোহন, জেলা: ভোলা বর্তমান ঠিকানা : বাসা/মহল্লা: রায়েরবাগ দোতলা মসজিদ, থানা: যাত্রাবাড়ী, জেলা: ঢাকা পরিবারটির সহযোগিতা প্রসঙ্গে প্রস্তাবনা-১: পরিবারটির আর্থিক সহযোগিতা জারি রাখার স্বার্থে শহীদের বড় ভাইয়ের একটি চাকুরির ববস্থা করা যেতে পারে প্রস্তাবনা-২: শহীদের গ্রামের বাড়িতে একটি রাস্তা তৈরী করা দরকার। সরকার নির্ধারিত খাস জমি বরাদ্দ আছে প্রস্তাবনা-৩: নিয়মিত মাসিক আর্থিক সহায়তা করা যেতে পারে