জন্ম তারিখ: ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : ছাত্র (পাশাপোল ডিগ্রি কলেজ, দ্বাদশ শ্রেণি), শাহাদাতের স্থান : জাবের হোটেলের অগ্নিকান্ড
‘আম্মু হাসিনা পদত্যাগ করেছে।’ - শহীদ হাফেজ মো: রাসেল রানা (বাশার) শহীদ হাফেজ মো: রাসেল রানা ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে যশোর জেলার সদর থানার দেয়ারা ইউনিয়নের আলমনগর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সে পাশাপোল ডিগ্রি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। তার পিতা মো: আব্দুল কুদ্দুস (মৃত) পেশায় একজন কৃষক ছিলেন এবং তার মা আঞ্জুআরা বেগম (৪০) পেশায় একজন গৃহিণী। তারা তিন ভাই-বোন। বড় বোন রাবেয়া সুলতানা (২২) তিনি বিবাহিতা। ছোট ভাই মো: তারেক হোসেন তুষার (১৫) দশম শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার সামগ্রিক বর্ননা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসজুরে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথমে কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদ হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার যখন এই শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে তার গুন্ডা বাহিনী ছাত্রলীগকে পাঠালেন সমাবেশকে নস্যাৎ করার জন্য তখন সেই গুন্ডালীগ বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের নিরীহ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর ন্যাক্কারজনক হামলায় মেতে ওঠে। তারা ১০ তলা ছাদের উপর থেকে মিছিলরত নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর ইট, ফুলের টব, পাথর নিক্ষেপ করে পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে। উপর থেকে ইট, ফূলের টব, পাথর নিক্ষেপের ফলে একের পর এক মিছিল্কারী শিক্ষার্থীদের মাথা ফেটে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে থাকে। আহত শিক্ষার্থীদের যখন ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয় সেই সময় তাদের গুন্ডাবাহিনী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, এমনকি রাস্তার টোকাই ভাড়া করে হাসপাতালে আহতদের উপর পুনরায় হামলা করে। এমনকি তারা শিক্ষার্থী বোনদের নির্মমভাবে রক্তাক্ত করে। এসময় পুলিশলীগ শুধু নিরব দর্শকের মতো ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে। যার ফলে দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা নিজেদের অঞ্চলে আন্দোলন করতে পারে না তারা নিকটবর্তী মফস্বল বা শহরে গিয়ে হলেও হান্দো আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পরে কেননা স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের অত্যাচার সকলের রক্তে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেরকমই একজন প্রতিবাদী বীর সৈনিক হাফেজ মো: বাশার। যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দেয়ারা ইউনিয়নের আলমনগরে বসবাস করত। সেখান থেকে আন্দোলনে যোগদান করা অত সহজ কাজ ছিলনা। পারি দিতে হয় যে অনেক পথ। কিন্তু এই দুর্বার তরুণকে ঠেকায় কে। তার রক্তে তখন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। তাই সে আর বাসায় বসে থাকতে না পেরে আন্দোলনে যোগদান করতে সকল ব্যাধা পেরোয় এবং প্রতিদিন যোগ দেয় যশোর শহরের আন্দোলনে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী হওয়ায় তার সাথে শিবিরের আরও কিছু কর্মী সাথী তার সাথে প্রতিদিন আন্দোলনে যোগদান করে। ৪ আগস্ট বাসা থেকে বের হতে দেরি হাওয়ায় সেদিন আর আন্দোলনে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য হয়নি বাশারের। সে বাসায় ফিরে আসে মনমরা হয়ে। তার মা আঞ্জুয়ারা বেগম তাকে মনমরা দেখে বলে - তোর কি হয়েছে বাবা? মনমরা হয়ে আছিস কেন? বাশার বলে - কিছু না মা এমনিই। কিছু ভালো লাগছেনা। তার মা তাকে জোড়াজুড়ি করে বললে সে বলে - আজ আমার সকল সাংগঠনিক ভাইয়েরা আন্দোলনে গিয়েছে মা শুধু আমিই যেতে পারলামনা। তার চোখের কোনে পানি জমতে থাকে। এটা দেখে তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলে, - আজ যেতে পারিসনি তো কি হয়েছে, কালকে যাবি। মায়ের স্বান্তনা পেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয় বাশার। কিন্তু সারাটা দিন তার অস্থিরতায় জাটে। কোনো সহপাঠী, বন্ধু বা সাংগঠনিক ভাইয়ের খোঁজ সে নিতে পারছিল না। অবশেষে ৫ আগস্ট সকালে বাশার ছাত্রশিবিরের এক সাংগাঠনিক ভাই এবং স্থানীয় মসজিদের ইমামের সাথে আন্দোলনে যায়। সেদিন ছাত্র-জনতার আন্দোলন অন্যান্য দিনের তুলনায় আরও বেশি তীব্রতর হয়। প্রতিটি শহর মফস্বল, থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলনকারীতে ভরে যায়। এত তীব্র আন্দোলনে ভয় পেয়ে পেয়া ছাত্রলীগ আগেই পালিয়ে যায় কিন্তু পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বাহিনী বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে থাকে। যখন ছাত্র-জনতা এসব গুলিকে তোয়াক্কা না করে গণভবনের দিকে রওয়ানা হয়, তখন খুনী, ভীতু, জালিম শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই খবর পেয়ে সবাই আনন্দে কান্না করতে থাকে। সকলে বিজয় মিছিল বের করে এবং যারা আগেই মিছিলে ছিল তার গণভবনে গিয়ে আনন্দ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই আনন্দ মিভহিল বের হয়। এসময় বাশারও আনন্দে কান্না করে ফেলে। আনুমানিক দুপুর ২:৩০টায় সে তার মাকে ফোন দিয়ে আনন্দিত কন্ঠে বলে - আম্মু হাসিনা পদত্যাগ করেছে - তাই নাকি? সত্যি? আলহামদুলিল্লাহ! তুই এখন কোথাই আছিস বাবা? - আম্মু আমি মিছিলে আছি - ঠিক আছে দ্রুত বাসায় চলে আয় - ঠিক আছে আম্মু আমি দ্রুতই আসব এই বলে ফোন রেখে দেয় বাশার। আনন্দ মিছিলে এক পর্যায়ে বাশারের সাথীরা তাকে হারিয়ে ফেলে। এরপর তার সাথে পরীবারে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে বাশার বাসায় না আসায় তার মা সেই নাম্বারে ফোন দেন যে নাম্বারে দুপুরে তার সাথে কথা হয়েছে, দিয়ে জানতে পারেন যে, বাশার তাদের সাথে নেই। এরপর পরিবার এবং আন্দোলনকারীরা বাশারকে খুঁজতে থাকে। ইমাম এবং তার সহপাঠী সাথী হাশপাতালে খুঁজতে গিয়ে এক পর্যায়ে স্থানীয় তাকে মর্গে শণাক্ত করে। জানা যায় জাবের হোটেলের অগ্নিকান্ডে তাকে মৃত উদ্ধার করা হয়েছে। তার পোড়া লাশ দেখে না এবং ছোট ভাই ঠিক থাকতে পারেনি। তার মা অজ্ঞান হয়ে যায় আদরের সন্তানকে হারিয়ে। জানাযা গোসল করিয়ে, কাফন পড়িয়ে অবশেষে আলমনগরে বাশারের জানাযা হয়। পারিবারিক কবরস্থানেই তাকে কবরস্থ করা হয়। তার সহযোদ্ধাদের মন্তব্য তার সহযোদ্ধা ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম বলেন,” বাশারবেকজন নির্ভীক ছেলে ছিল। নিয়মিত নামাজ পড়ত। সবসময় সে সামাজিক কাজে নিয়োজিত থাকত। সে কোরানের হাফেজ ছিল এবং বেশ কয়েকবার তারাবির নামাজও পড়িয়েছে সে। পরিবারের বর্তমান অবস্থা তাদের পরিবারে বর্তমানে আয় রোজগার করার মতো কেউ নেই। প্রথমত সন্তান হারানোর কষ্ট, দ্বিতীয়ত আর্থিক অভাব অনটনের মাঝেই দিন কাটাচ্ছে বাশারের পরিবার। পারিবারিক অবস্থা বাশারের বাবা একজন দরিদ্র কৃষক ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে ইহলোক পরিত্যাগ করেন। এতে পরিবারটিকে বিপাকে পড়তে হয়। পরিবারে বাশারের একটি ছোটভাই আছে। বড়বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাশারে বাবা মারা যাওয়ার আগে কৃষি কাজ করে হাজার দশেক টাকা মাসে ইনকাম করে কোনোমতে সংসার চালাতেন। কিন্তু ওনার মৃত্যুর পরে পরিবারে আয়-রোজগার করার মত কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় বাশারকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়। যেহেতু বাশার একজন কোরআনের হাফেজ ছিল এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিল তাই অনায়াসেই সে তারাবী নামাজ পড়িয়ে এবং কোরআন পড়িয়ে যে হাদিয়া পেত, তাই দিয়েই সংসারে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেন। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : হাফেজ মো: রাসেল রানা জন্ম তারিখ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ বাবার নাম : মো: আব্দুল কুদ্দুস মায়ের নাম : আঞ্জুআরা বেগম পেশা : ছাত্র (পাশাপোল ডিগ্রি কলেজ, দ্বাদশ শ্রেণি) স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম-আলমনগর, ইউনিয়ন : দেয়ারা, থানা : সদর, জেলা: যশোর স্থায়ী ঠিকানা : ঐ পরিবারের সদস্য : ৩ জন, (মা এবং ছোট ভাই) ঘটনাস্থল : জাবের হোটেলের অগ্নিকান্ড ঘটনা ও মৃত্যুর তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪ পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা ২। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার ব্যয় বহন করা এবং পড়াশোনা শেষে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেওয়া