জন্ম তারিখ: ৫ এপ্রিল, ২০০৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : ছাত্র, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, যশোর। শাহাদাতের স্থান : জাবির হোটেল, চিত্রার মোড়, যশোর সিটি, যশোর।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান বিশ্বে একটি বিরল উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই বিশাল গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বেচ্ছাচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের দীর্ঘদিনের অসন্তোষ এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই অভ্যুত্থানে স্কুল কলেজের ছাত্ররাও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল, যার মধ্যে শহীদ মো: সাওয়ান্ত মেহতাব প্রিয় অন্যতম। প্রিয় যশোর সদরের মুজিব সড়কের বাসিন্দা ২০০৬ সালের ৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি সিটি কলেজ, যশোরের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া এবং মানবিক কাজে অসংখ্য মানুষের সহায়তা করার জন্য তিনি সবার পরিচিত ছিলেন। প্রিয়'র বাবার নাম মোঃ শাকিল ওয়াহিদ। তিনি একজন হোমিও চিকিৎসক; যশোরের রেলগেট এলাকায় একটি হোমিওপ্যাথি ক্লিনিক পরিচালনা করেন। তার মা রেহেনা পারভিন গৃহিণী। পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল এবং প্রিয় সব সময় মানুষের সাহায্যার্থে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। শাহাদাতের ঘটনার বিবরণ জুলাই মাস। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের জুলুম-বৈষম্য চরম সীমায় পৌছে গেছে। সর্বক্ষেত্রে আওয়ামী সিন্ডিকেট এতটাই প্রকট যে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি এতটাই চরমে পৌঁছে গেছে যে, একটা চাকুরীর হাহাকার যুবকের মৃত্যু যন্ত্রনার মতো। কোটা নামক বৈষম্য তরুণ-যুবার জন্য যেন ফ্যাসিবাদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে খুনি হাসিনা আওয়ামী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয়। নারী শিক্ষার্থীদের গায়ে সহিংস আক্রমণ করে রক্তাক্ত করে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বেপোরোয়া হয়ে উঠে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী। দেশীয় ও অগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্রদের খুন করতে নেমে পড়ে স্বৈরাচারী সরকার। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহীনী এক হয়ে নির্মম দমন পীড়নের মাঝেও আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর শহরজুড়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাধারণ জনতা রাজপথে নেমে পড়ে। খুনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাজ পথে নেমে পড়ে। ৫ তারিখে স্বৈরাচারের পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন শহীদ প্রিয়। জুলাই মাসজুড়ে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনে প্রিয় শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। বাবার কাছ থেকে ৪০ টাকা নিয়ে তিনি বাসা থেকে বের হন। ৭ টায় ফিরে আসার কথা বলে। প্রিয় তাঁর বিন্ধুদের সাথে বিজয় মিছিলে যোগ দেন এবং যশোর শহরে জাবির হোটেলে দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে প্রিয় সেখানে চলে যান। জাবির হোটেলের সামনে এসে তিনি একটি বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে হোটেলের ভিতরে যেতে চান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত তার জনৈক বন্ধু বলে, ‘তুই ভিতরে যাইস না, ভিতরে অনেক ধোঁয়া।‘ তিনি বন্ধুর কথা না শুনে ভিতরে চলে যান এবং এক পর্যায়ে সেখানে আটকা পড়েন। এদিকে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও বাসায় না ফিরায় বাবা মা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে কল দেন কিন্তু ফোন বন্ধ পান। প্রিয় সব সময় প্রথম বা দ্বিতীয় রিং বাজতেই বাবা মায়ের ফোন রিসিভ করেন, কিন্তু এবারে রিসিভ না করায় তাঁরা আরও বেশি আতংকিত হয়ে পড়েন। প্রিয়র বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেও তাঁরা প্রিয়'র কোনো খোজ না পেয়ে পরবর্তীতে বন্ধুদের সহায়তায় যশোর সদর হাসপাতালে প্রিয়র মরদেহ খুজে পান প্রিয়র বাবা মা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা ছিল তাঁর এই আন্দোলন এবং জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা। মৃত্যুর মাত্র ১২ দিন আগে, প্রিয় তার বাবা-মাকে বলেছিল, “বাবা, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, আমাকে দাদার কবরের পাশে কবর দিও।” তার সে কথা অনুযায়ী প্রিয়কে স্থানীয় কারবালা কবরস্থানে তার দাদার কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে। স্বজনদের অনুভূতি/অভিব্যক্তি শহীদ প্রিয়র বাবা জনাব শাকিল ওয়াহিদ বলেন, “প্রিয় ছোটবেলা থেকে মানব হিতৈষী কাজে যুক্ত ছিল। মানুষকে রক্তদান করতো এবং অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছিল তার নিয়মিত কাজ। সে প্রায়ই আমার চেম্বারে রোগী নিয়ে আসতো। আমাকে বলতো ফ্রি চিকিৎসা করে দিতে। বিপদে আপদে সবসময় মানুষের সেবা করতো। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গরীবদের দান করতো। সে সবসময় মাকে বলতো, দেখো আমি এমন কিছু করে যাবো আমার নামে সড়ক হবে, ভবন হবে। আমাদের প্রিয় নিয়মিত নামাজ পড়তো। মুগ্ধ এবং আবু সাইদের কথা বলে সে কান্না করতো। বলতো, দেখো এত সুন্দর ভাইয়াটা শহীদ হয়ে গেছে। এত দুরন্ত ছেলেটা আমার খুব ভুলোমন ছিল। সে তার জুতার ফিতাটাও বাধতে পারতোনা। তার জুতার ফিতা বেধে দিতো আমার ছোট ছেলে। একদিন আমি প্রিয়কে জিজ্ঞাসা করলাম আন্দোলনে তার পোস্ট কি, সে বলে আমার পোস্ট লাগে না আমি বরঞ্চ পোস্ট দিই।” প্রিয় তার বাবা-মাকে বলতো-তোমাদের আরও ২ সন্তান আছে। ৭১ সালে তোমাদের মতো বাবা মা থাকলে দেশ আর স্বাধীন হতোনা। তার পছন্দের খাবার ছিল ডিম আর সাদাভাত। বিসমিল্লাহ বলে খাবার শুরু করতো এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে শেষ করতো। তার পছন্দের খাবার ছিল ডিম আর সাদাভাত।” একনজরে শহীদের পরিচয় পূর্ণ নাম : মো: সাওয়ান্ত মেহতাব জন্ম তারিখ : ০৫/০৪/২০০৬ পেশাগত পরিচয় ও প্রতিষ্ঠান : ছাত্র, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, যশোর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: সাতমাইল, ইউনিয়ন: বাগয়াচড়া, থানা: শার্শা, জেলা: যশোর সর্বশেষ ঠিকানা : বাসা: গ্রীন বাজার, এলাকা: মুজিব সড়ক, থানা: যশোর সদর, জেলা: যশোর পিতার নাম : মো: শাকিল ওয়াহিদ পিতার পেশা ও বয়স : হোমিও চিকিৎসক, ৪০ মাসিক আয় : ৩৫,০০০/- (প্রায়) মাতার নাম : রেহেনা পারভিন মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৩৭ পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৫ (পাঁচ) ভাই-১: আসওয়াদ মনির (১৩), যশোর জিলা স্কুলে ক্লাস ৭ পড়ুয়া ভাই-২: দাইয়ান মাহদীন (১১), নব কিশলয় স্কুলে ক্লাস ৬ পড়ুয়া ঘটনার স্থান : জাবির হোটেল, চিত্রার মোড়, যশোর সিটি, যশোর মৃত্যুর কারণ : জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিহত আহত ও নিহত হওয়ার সময় ও স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪, জাবির হোটেল শহীদের কবরস্থান : কারবালা কবরস্থান, যশোর (গুগল লোকেশন http://maps.app.goo.gl/17EXaA94NGi5qbFB9)) পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য এককালীন ভাতার ব্যবস্থা করা।