Image of মো: বাবলু ফরাজী

নাম: মো: বাবলু ফরাজী

জন্ম তারিখ: ৪ জুলাই, ১৯৬৬

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: খুলনা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান : সদর হাসপাতাল, কুষ্টিয়া

শহীদের জীবনী

সদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন শহীদ মোঃ বাবুল ফরাজী। তিনি ৪ জুলাই ১৯৬৬ সালে কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত নওশের আলী এবং মাতা মৃত মোছাঃ বুড়ী খাতুন। একজন সৎ, আদর্শবান মানুষ হিসেবে এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে। কর্মঠ বাবুল নানা সামাজিক কাজে সবসময় ছিলেন অগ্রসরমান। দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ সুপরিচিত। পারিবারিক অবস্থা সভ্রান্ত ফ্যামিলির সন্তান ছিলেন শহীদ বাবলু ফরাজী। তার পরিবারের সদস্যদের সাথে একান্তে কথা বলে জানা যায় বর্তমানে পরিবারের আর্থিক অবস্থা একেবারেই নাজুক, যার কারণে তিনি ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। শহীদ বাবলু ফরাজীর স্ত্রী জটিল রোগে আক্রান্ত এবং ছেলে কিডনী রোগে আক্রান্ত। তাঁর ৩০ বছর বয়সী ছেলে সুজন মাহমুদ বর্তমানে বেকার। অর্থাভাবে সুচিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছেনা। পরিবারটি হটশ হরিপুর, কুষ্টিয়ায় নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাঁর মেয়ে মোছাঃ হেলেনা বিবাহিত এবং গৃহিণী। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরুন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয়। আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে নেমে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান বাংলাদেশ নামক গাড়িটা যখন এমনভাবে ব্রেক ফেইল করলো আর বাংলাদেশী নামক যাত্রীরা যখন আতঙ্কিত; চারদিকে যখন কষ্ট, বেদনা, চিৎকার, আহাজারি আর নিশ্চিত ধ্বংসের সুস্পষ্ট লক্ষণ, তখন শহীদ বাবুল ফরাজীর মত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তি কি বসে থাকতে পারেন? তাঁর হৃদয়ে কি দাগ কাটতে পারেনা? পারিবারিক নানা টানাপোড়নে থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন বর্বরতা দেখে সমাজ সচেতন একজন বাবুলের মনেও আঁচড় কাটতে পারে। কেননা সবকিছু তো তার সামনেই ঘটছে। তিনি নিজের কানেই শুনছেন মানুষের নিদারুণ আর্তনাদ; ব্যথিত মনের হাহাকার। নিজের চোখে দেখছেন কিভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে শাসক নামধারী শোষক গোষ্ঠী। নিজের নাতি নাতনি তুল্য আহত, নিহত শিক্ষার্থীদের নিজের সামনে যখন নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখছেন, তখন কি তার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে না? তিনিও তো রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। তাঁর মনেও প্রশ্ন জেগেছিল। তিনি ভাবতেন, এই দেশ কি আমার? এখানে আমার আর আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ কি? আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? আমরা কি আসলেই বেঁচে আছি? নাকি জীবন্ত লাশ? আমরাও কি আহত, নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের মতো বিমূর্ত হয়ে বেঁচে আছি? নাকি বাংলাদেশ নামক আয়নাঘরে গুম হয়ে প্রতিনিয়ত গোলামী করে যাচ্ছি কোনো এক নব্য ফেরাউনের? এরকম শত সহস্র প্রশ্ন জেগে উঠতো জনাব বাবুল ফরাজীর হৃদয়ে। কোনো উত্তরই তিনি খুঁজে পেতেন না। আর যখন খুঁজে পেলেন, তখন নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পাশেই। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান প্রতিবাদী কন্ঠস্বর- যিনি অন্যায়কে কখনো বরদাস্ত করেন না, তিনি হলেন মোঃ বাবলু ফরাজী। অভাব অনটনের সংসারে তিনি ফেরি করে কাপড় বিক্রির মাধ্যমে খরচ চালাতেন। মাস কয়েক আগে রাজশাহীতে তাঁর স্ত্রীকে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললেও টাকার অভাবে ২য় বার আর ডাক্তারের নিকট নিতে পারেন নি। এদিকে তাঁর ছেলে বেশ কিছু বছর যাবৎ কিডনি জনিত সমস্যায় ভুগছেন । আর্থিকভাবে খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছিলেন। পরিবারের অভাব থাকলেও সহজে কাউকে তিনি বুঝতে দিতেন না। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন তখন পরিবারের খরচ চালানোর মতো মাত্র ৩ হাজার টাকা ছিল। “আমি যুদ্ধে যাব শহীদ হব” ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় রুপ নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে স্বৈরশাসক খুনি হাসিনার পতন আন্দোলনে। সারা দেশের ন্যায় কুষ্টিয়ায়ও ‘এক দফা এক দাবি’ আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। অন্যান্য দিনের মতো ৫ আগস্টেও হাজার হাজার ছাত্র জনতা খালি হাতে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভ করতে থাকে। শহীদ বাবলু ফরাজী মুক্তিকামী মানুষের সাথে শুরু থেকেই আন্দোলনে যোগদান করে আসছিলেন। সেদিনও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। যেদিন শহীদ হবেন তার দুই দিন আগ থেকেই বলে আসছিলেন, “আমি যুদ্ধে যাব, শহীদ হব।” ৫ আগস্ট সকালে ভাত খেয়ে কাউকে না জানিয়ে কুষ্টিয়া শহরের চার রাস্তার মোড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। স্ত্রী তাকে বাড়িতে না পেয়ে ফোন দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে বললে শহীদ বলেন, “আমি যুদ্ধে আছি, খালি হাতে আসিনি, লাঠি হাতে নিয়ে এসেছি, আমি যুদ্ধ করব।” তার নাতনি ও তাকে আসতে বললে, তিনি একই উত্তর দেন। নাতনি রসিকতা করে বলে, “নানী তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।” তিনি জবাবে বলেন, “আমি আর বাড়িতে যাব না।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আন্দোলনে শহীদ বাবলু ফরাজি ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে কুষ্টিয়া শহরের চার রাস্তার মোড়ের লিয়াকত মিষ্টান্ন ভান্ডারের পাশে হাইস্কুল মাঠের গলিতে অবস্থান নেন। অবস্থানরত ছাত্রজনতার উপর শোষক খুনি সরকারের লেলিয়ে দেয়া ঘাতক বাহিনীর এস আই সায়েব আলীর নেতৃত্বে পুলিশের আলফা টিম নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। মুহুর্তেই গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেসময় আনুমানিক বিকাল ৩.০০-৩.১৫ মিনিটে বাবলু ফরাজী গুলিবিদ্ধ হয়। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একটি গুলি তার মাথার বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। বিপ্লবী বাবুলের রক্তাত নিথর দেহ পড়ে থাকে। শহীদের রক্তে রাজপথ রূপ নেয় এক রক্তগঙ্গায়। কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতে আন্দোলনরত জনতা ৩.২০ মিনিটে তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায় এবং তাকে ১০ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসা চলমান অবস্থায় বিকাল ৪.২০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সত্যিই শহীদ বাবলু ফরাজী জীবিত অবস্থায় আর বাড়িতে ফিরতে পারলেন না। তিনি তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতিকে রেখে চলে গেলেন আল্লাহর দরবারে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সাথে এলাকাবাসীও বাবলু ফরাজীর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। জানাজা ও দাফন হাসপাতাল থেকে শহীদের মরদেহ নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নামাজে জানাযা শেষে হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন কবরস্থানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শহীদ মোঃ বাবলু ফরাজীকে চিরনিদ্রায় শায়িত করাক হয়। শহীদ সম্পর্কে প্রতিবেশীর বক্তব্য প্রতিবেশী প্রভাষক জনাব শামীম বলেন, “শহীদ বাবলু ফরাজী একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি পরিশ্রমী ও সাহসী ছিলেন। যেখানেই অন্যায় দেখতেন তিনি প্রতিবাদ করতেন। এভাবে তাকে মরতে হবে কলপনাও করতে পারিনি। তাকে হারিয়ে আমরা খুবই কষ্ট অনুভব করছি।” একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: বাবলু ফরাজী জন্ম : ০৪-০৭-১৯৬৬ পিতা : মৃত নওশের আলী মাতা : মৃত মোছা: বুড়ী খাতুন পেশা : ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: হাটশ হরিপুর, ইউনিয়ন: হরিপুর, থানা: কুষ্টিয়া সদর , জেলা: কুষ্টিয়া আহত হওয়ার সময় : ০৫ আগস্ট, ২০২৪; বিকাল ৩.৩০ টা ঘটনার স্থান : চার রাস্তার মোড়, হাই স্কুল গলি, কুষ্টিয়া শহর মৃত্যুর তারিখ ও স্থান : ০৫ আগস্ট, ২০২৪; বিকাল ৪.২০ টা, সদর হাসপাতাল, কুষ্টিয়া আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক পুলিশ, এস আই সায়েব আলীর নেতৃত্বে কবরস্থান : হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন কবরস্থান প্রস্তাবনা ১। অসুস্থ ছেলে ও স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ২। আয়ের কোনো উৎস না থাকায় পরিবারটির জন্য এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: বাবলু ফরাজী
Image of মো: বাবলু ফরাজী
Image of মো: বাবলু ফরাজী
Image of মো: বাবলু ফরাজী
Image of মো: বাবলু ফরাজী

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আলমগীর সেখ

সৈয়দ মিথুন মোর্শেদ

মো: রাকিবুল হোসেন

মো: আবুল বাশার আদম

 মো: শাহারিয়ার

সাকিব রায়হান

মো: সাকিবুল হাসান মাহি

 মো: সাওয়ান্ত মেহতাব

মো: ফজল মাহাদী

মো: সুমন মিয়া

মো: রাজু আহমেদ

আলম সরদার

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo