জন্ম তারিখ: ১৩ নভেম্বর, ১৯৭২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা: মাছ ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান: এনাম মেডিকেল, সাভার,ঢাকা
জুলাই বিপ্লবের এক অখ্যাত নক্ষত্র মো: নবী নুর মোড়ল। লক্ষ ছাত্র-জনতার সাথে এক হয়ে নেমেছিলেন অত্যাচারী খুনী শাষকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তিনি পেশায় ছিলেন সাধারণ একজন মাছ ব্যবসায়ী। দায়িত্বশীল স্বামী এবং একজন পিতা হিসেবে তাঁর ভুমিকা ছিল অনন্য। ১৯৭২ সালের ১৩ নভেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা গ্রামে মৃত মো: করিম মোড়ল ও তহুরা বিবি দম্পত্তির ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে বাবা-মায়ের আদরে প্রিয় সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় শহীদ পিতা ছেলেকে খুব বেশি লেখাপড়া করাতে পারেননি। এরপর নিজের সাথে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করেছেন। বাবার সাথে বেড়ে ওঠার ফলে সেখান থেকে নৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। মানুষের আনন্দে আনন্দিত হওয়া, অন্যের দুঃখে ব্যাথিত হওয়া এসব মানবিক দিকগুলো তাঁর ভেতর স্থান পায়। মাতা তহুরা বিবির বয়স ৮০ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত কারনে অসুস্থ। দুই মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাতা কে নিয়ে একটু সুখের জন্য ৬ বছর আগে খুলনার পাইকগাছা থেকে ঢাকায় আসেন নবীনুর। সাভারে কি করবেন তখনও ঠিক করেন নি। পরে নিজের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে নবীনূর মোড়ল ফুটপাতে মাছ ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার সাথে সাথে তিনি দেশেরও খোজ খবর রাখতেন। পরিবারের সবার জন্য কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে তাদের কল্যাণে খরচ করতেন। মাছ ব্যবসায় যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার খুব ভালোভাবে চলতো না। পরিবারে দুই মেয়ে ও স্ত্রীর সাথে অসাধারণ বন্ধন ছিল তাঁর। মেয়েদের অত্যন্ত স্নেহ আর ভালবাসা দিয়ে বড় করছিলেন। বড় মেয়ে নাজমা বেগমকে (২২) সুপাত্রে পাত্রস্থ করেন। ৬ বছর একাধারে ব্যবসা করে ধীরেধীরে সকল ধার দেনা শোধ করেন। শহীদের ইচ্ছা ছিল ছোট মেয়ে ফাহিমাকে (১৮) ভাল পাত্রের কাছে বিয়ে দেবেন। খুলনার পাইকগাছাতে ছোট করে মা ও স্ত্রী কে নিয়ে একটা সুখের নীড় গড়ে তুলবেন। তিনি ছিলেন একজন যোগ্য পিতা, একজন যোগ্য স্বামী, একজন যোগ্য সন্তান। মানবিক হয়ে ওঠা মানুষটা সাভার ধামরাইতে বসবাস শুরু করেন তার পরিবারের জন্য। অর্থনৈতিক অবস্থা মো: নবীনুর মোড়ল একজন অতি দরিদ্র মাছ ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁকে হারিয়ে তাঁর স্ত্রী গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। বর্তমানে ভীষণ কষ্টে নবীনূর মোড়লের রেখে যাওয়া সংসার চলছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হলো বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয় এবং এটি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ২০২৪ সালের ১ জুলাই সংগঠনটি সৃষ্টি হয় এবং সৃষ্টির পরপরই আন্দোলন সফল করার জন্য ৮ জুলাই সংগঠনটি ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করে, যার মধ্যে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ২০ জুলাই, শনিবার দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েনের মধ্যেও যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর এলাকায় চলে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। নবীনূর মোড়ল জুলাই এর শুরুতেই ছাত্রজনতার যৌক্তিক এই আন্দোলনের সাথে একাত্ততা পোষণ করেন। মাছ ব্যবসায়ী হলেও জুলাইয়ের বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় ছিলেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি আন্দোলনের শুরুতেই মাছ বিক্রি ও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি তার সমবয়সী এবং সাধারণ মানুষকে এই আন্দোলনে একত্রিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। মানুষকে এই আন্দোলনে একত্রিত করার পাশাপাশি তিনি শহীদ হওয়ার আগের দিন ছাত্র-জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া র সাথে যুক্ত হন। এর পরের দিন বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভ মিছিল এ অংশগ্রহণ করলে সেদিন ও পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। বিক্ষোভ মিছিল এর শেষের দিকে, ৫ টার দিকে সাভারের ওয়াপদা রোদ সংলগ্ন রহমান মার্কেটের সামনে পুলিশের গুলি তাকে আঘাত করে। এরপর তাকে দ্রুত এনাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে তার রাত ৯ টা পর্যন্ত জ্ঞান ছিল। কিন্তু শহীদের স্বজনদের হাজার কাকুতি মিনতির পরও অপারেশন করা হয়নি এবং গুলি বের করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিনি তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জামাইকে বার বার জানিয়েছিলেন তাকে যেন অন্তত একটা ব্লেড দিয়ে হলেও কেটে বুলেট টা বের করে দেওয়া হয়। রাত ৯ টার পরে তীব্র ব্যথায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সে অবস্থায় তিনি ২১ জুলাই রাত ২.০০ টায় ইন্তেকাল করেন। মারা যাওয়ার পরও তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। শহীদ পরিবারের সাথে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে শহীদের জামাই ৪১ হাজার টাকা জমা দিয়ে লাশ ছাড়িয়ে আনেন। এই অকুতোভয় শহীদকে শেষ সমাধি দেওয়া হয় নিজ গ্রাম খুলনার পাইকগাছায়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি মা-‘আমার ছেলের মত আরেকটা ছেলে হয়না। সারাজীবন আল্লাহর রাস্তায় চলার চেষ্টা করেছে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত নসিব করুন।’ স্ত্রী-‘তিনি ছিলেন এই সংসারের বটগাছ। মেয়েদের খুব ভালবাসতেন। ইচ্ছা করে কখনও নামাজ ছাড়তেন না। আমাকে আর মেয়েদেরকে সবসময় সৎ থাকার, নামাজ, রোজা ঠিকমতো পড়ার তাগাদা দিতেন। তিনি বলতেন মেয়েরা আমার মাথার তাজ। ছোট মেয়েকে হিফয ভর্তি করেছেন। কত স্বপ্ন ছিল আমার স্বামীর। আল্লাহ তার সকল ইচ্ছা পুরন করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। তিনি শহীদ হয়েছেন। মহান আল্লাহ তার মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু হিসেবে কবুল করুন।’ জামাই- ‘আমার শ্বশুর হিসেবে বলছি না, তার মত অমায়িক মানুষ খুব কমই আছে। আমাকে কখনও আব্বু ছাড়া ডাকেন নি। উনি সবাইকে খুব ভালবাসতেন। ইসলামের ব্যাপারে সবসময় সবাইকে সাবধান করতেন। আমি তাঁকে কখনও নামাজ ছাড়তে দেখিনি। সবার সাথে তাঁর এতটা ভাল সম্পর্ক ছিল যে যখন এনাম মেডিকেল থেকে চিকিৎসা খরচ বকেয়া থাকায় লাশ ছাড়ছিল না, তখন সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। সে সময় আমাদের হাতে একেবারেই টাকা ছিল না।’ প্রতিবেশী-‘তিনি খুব সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। নিয়মিত প্রতিবেশীদের খোজ খবর রাখতেন। সকলের সাথে অমায়িক ব্যবহার করতেন। মাছ ব্যবসায়ি হলেও তিনি সমাজের ভাল কাজগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকতেন। ধর্মীয় কাজে নিজেকে সর্বদা উজাড় করে দিতেন। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: নবী নুর মোড়ল জন্ম : ১৩-১১-১৯৭২ পেশা : মাছ ব্যবসায়ী মাসিক আয় : ১০,০০০/- স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শ্রীকন্ঠপুর, ইউনিয়ন : বাড়ুলি, থানা: পাইকগাছা, জেলা: খুলনা বর্তমান ঠিকানা : বাসা: বনপুকুর, এলাকা: সাভার, থানা: সাভার, জেলা: ঢাকা পিতার নাম : মৃত মো: করিম মোড়ল মাতার নাম : তহুরা বিবি, বয়স: ৮০ পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৩ জন (স্ত্রী, মা ও ছোট মেয়ে ফাহিমা) ঘটনার স্থান : ওয়াপদা রোড, সাভার রহমান মার্কেট আক্রমনকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : ২০-০৭-২৪, বিকাল: ৫:০০ ঘটিকা মৃত্যুর তারিখ ও সময় স্থান : ২১-০৭-২৪, রাত: ২:০০ ঘটিকা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : পারিবারিক কররস্থান প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদের কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ খরচ যোগানে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে ৩. শহীদ জননীকে চিকিৎসা বাবদ সহযোগিতা করা যেতে পারে
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করেছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মারে ও মরে। (সুরা তাওবা ৯:১১১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “শহীদদের জন্য জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।” (সহীহ বুখারী ২৮০০)



