জন্ম তারিখ: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ফ্রিল্যান্সার শাহাদাতের স্থান : মিরপুর-১০, গোলচত্বর, ঢাকা
''মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছেলেটিও স্বৈরাচারের বুলি হলেন।'' শহীদ পরিচিতি শহীদ মো: ইমন হোসেন ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান ঢাকার শরীয়তপুরে। তার পিতা মো: মতিউর রহমান এবং মায়ের নাম মোসা: বেবী আক্তার। জন্মের কিছুদিন পরেই পিতা-মাতার বিচ্ছেদ ঘটে। শহীদ ইমন তার মায়ের কাছেই বড় হতে থাকেন। তার মা ছাত্রদের মেসে রান্নার কাজ করে তাকে লালন-পালন করতেন। ইমন বড় হয়ে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শিখে সংসারের হাল ধরেন। মা-ছেলে মিরপুরের পল্লবীতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রাায় সময় তিনি অসুস্থ থাকেন। অসুস্থ মায়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল ছেলে ইমন। ছোট থেকেই সে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শহীদ ইমন ছিলেন নির্লোভ, কষ্ট সহিষ্ণু, কর্মচঞ্চল ও ত্যাগী যুবক। তার আচরণে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন ও সহকর্মীরা খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। শহীদ মো: ইমন ছোট থেকেই তার পরিবারে এক সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আসছেন। শৈশবেই তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং বাবা অন্যত্র বিয়ে করে। শহীদ ইমন ও তার মায়ের সাথে যাবতীয় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ছেলেকে আকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিলেন মা। কিন্তু তা আর হল না। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্তরে পুলিশ বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন শহীদ ইমন হোসেন আকাশ। যেভাবে শহীদ হলেন ইমন হোসেন ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল মূলত হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনের ফসল। ক্ষমতায় এসেই হাসিনার সরকার অন্যায় অত্যাচার শুরু করে। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। আওয়ামীলীগের এমপি মন্ত্রীরা একেকটা রাঘব বোয়ালে পরিণত হয়। উন্নয়নের নাম করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে। দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজ, মানি লন্ডারিং, কালোবাজারি, সিন্ডিকেটরে মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যায়। আওয়ামী সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু এই খাতটাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়। শিক্ষা বিভাগে অযোগ্য লোকদের বসিয়ে এই খাতটাকে কলংকিত করে। সৃজনশীলতার নাম করে দেশকে মেধাশূণ্য করার সব রকম আয়োজন সম্পন্ন করে। ২০২৪ সালে নতুন এক কারিকুলাম প্রণয়ন করে নৈতিকতা বিবর্জত এক জাতি গঠনের ষড়যন্ত্র করে। অভিবাবকরা প্রতিবাদ করলে তাদের প্রতিহত করতে অমানবিক পন্থা অবলম্বন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় অযাগ্য লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে জাতিকে মেধাশূন্য করে ফেলে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয় লোকদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের পুলিশ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেয়। পুলিশ বাহিনীর উপর মানুষের চরম ঘৃণা আর ক্ষোভ জন্ম নেয়। ক্রমবর্ধমান বাজার মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবন একদম অতীষ্ঠ হয়ে যায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণির মানুষ অতিরিক্ত বাজার মূল্য বহন করতে না পেরে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে থাকে। চারদিকে ধনী-গরীবের বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। দেশে বেকার সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। অথচ সমাধানের কোনো উদ্যোগা দেখা যায় না। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার মাধ্যমে মেধাবীদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়। অযোগ্য লোকজন দিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। দেশের মেধাবীরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়। বিসিএসে ৫৬% কোটা বহাল রাখা হয়। এছাড়াও সরকারের সকল চাকরিতে ৮৫% পর্যন্ত কোটা চালু করা হয়। বৈষম্য চরম আকার ধারণ করলে ছাত্র-জনতা সোচ্চার হয়ে উঠে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ২০১৮ সালে। ডাকসুর ভিপি নুরের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা দাবী আদায়ে মাঠে নামে। আন্দোলন দমাতে নুরুর উপরে হামলা করে ক্ষমতাসীনদের দোসররা। ছাত্রলীগ হামলা চালায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর। আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাহী আদেশে কোটা প্রথা বাতিল ঘোষণা করে। ২০২৪ সালে এসে হাইকোর্ট এক আদেশে এই নির্বাহী আদেশকে বাতিল ঘোষণা করে। আবরও শুরু হয় আন্দোলন। ছাত্রদের কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনে আওয়ামী নরপিশাচদের হামলায় মুহুর্তেই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রুপ নেয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে। দেশের মুক্তিকামী মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। চতুর্দিক থেকে মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই সাধারণ ছাত্ররা নায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে শাহাবাগ ও ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। ছাত্রদের দমন করতে সরকার তার দলীয় পোষা গোণ্ডা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানের নির্দেশে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী লোহার রড, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, রামদা, চাপাতি ও দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে নিরীহ ছাত্র- জনতার উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের পোষা গোণ্ডা এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাড়া করে আনা গোণ্ডাদের নিয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের হামলার হাত থেকে নিরস্ত্র বোনেরাও রক্ষা পায়নি। রাস্তায় আটকিয়ে বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে তাদেরকে নির্বিচারে পিটাতে থাকে। রাতে স্বৈরশাসক খুনি হাসিনা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেয়। মুহুর্তেই ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মধ্যরাতে ঢাবির হলগুলো থেকে ভেসে আসে, “তুমি কে আমি কে?- রাজাকার, রাজাকার।” মুহুর্তেই ৭১’র ঘৃণিত শব্দ ২৪ এ এসে মুক্তির স্লোগানে পরিণত হয়। এ ছিল এক বড় আয়রনি। ৪ আগস্ট ২০২৪ রবিবার দুপুর ১টার সময় ইমন হোসেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে বাসা থেকে বের হয়। মিরপুর ১০ এ এসে অবস্থান নেন। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারসেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। ছাত্র-জনতা ইট পাটকেল ছুড়ে পুলিশকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ বাহিনী অতর্কিত গুলি চালালে সেখানে ছাত্র জনতা টিকে থাকতে পারে না। কাঁদানো গ্যাসের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। একের পর এক সাধারণ শিক্ষার্থী গুলি বিদ্ধ হয়ে রাস্তায় মুখ থবিড়ে পড়ে। অনেকে সেন্সলেস হয়ে যায়। আহত হয় শতাধিক। মুহুর্তের মধ্যেই মিরপুর ১০ এলাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ ইমন হোসেন আকাশ গুলিবিদ্ধ মানুষকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর কাজ শুরু করে দেয়। পানি নিয়ে এগিয়ে যান পিপাসার্তদের পানি পান করাতে। কিন্তু পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। মাগরিবের কিছু সময় আগে ঘাতক বাহিনীর একটি গুলি এসে ইমনের মাথার ডান পাশ দিয়ে প্রবেশ করে বামপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরন করেন তিনি। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শহীদ মো: ইমন হোসেন আকাশ পেশা : ফ্রিল্যান্সার জন্ম তারিখ : ২৮/০৯/২০০২ পিতা : মো: মতিউর রহমান মাত : মোসা: বেবী আক্তার শাহাদাতের তারিখ : ৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার আহত হওয়ার স্থান : মিরপুর ১০, গোলচত্বর, ঢাকা শাহাদাতের স্থান : ৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, বাদ মাগরিব, মিরপুর-১০, গোলচত্বর স্থায়ী ঠিকানা : শরীয়তপুর, ঢাকা বর্তমান ঠিকানা : মিরপুর ১০, ঢাকা দাফন : তার প্রথম জানাজা মিরপুরে অনুষ্ঠিত হয়। এবং দ্বিতীয় জানাজা শরিয়তপুর মাতবকান্দি গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়