জন্ম তারিখ: ২২ জুন, ২০২৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান: মোহাম্মদপুর
শহীদ রাজুর পিতা মো: আবুল কালাম মোল্লা (৬০) ও মাতা মোসা: নাছিমা খাতুন (৫৮)। শহীদ জনয়িতা পেশায় কৃষক আর জননী একজন চিরাচরিত বাঙালি গৃহিণী। কালাম-নাছিমা দম্পতি দুজনেই অসুস্থ। এই পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৬ জন। রাজুর বড়ভাই নাজিম উদ্দিন মালয়েশিয়া প্রাবসী। তাঁর আয়েই মূলত রাজুদের সংসার চলতো। বাবা-মাকে দেখাশোনা করতেন রাজুই। অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে মাঝেমাঝেই ছোটাছুটি করতে হতো তাঁকে। তিনি ছিলেন বয়সের ভারে নূজ্য বাবা-মায়ের একমাত্র হাতেখড়ি অবলম্বন। এখন কে দেখবে শহীদের অসুস্থ অসহায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে? শিক্ষা ও ব্যক্তিজীবন শহীদ রাজু মাগুরা আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। রাজু আহমেদ জগদল সম্মিলনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মাগুরা আদর্শ কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। অভাবের সংসার ছিল তাঁদের। মাসিক আয় বিশ হাজার টাকা মাত্র। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে লেখাপড়ায় নিয়মিত হতে পারেননি ২৪ এর শহীদ রাজু আহমেদ। সংসারের হাল ধরার জন্যও সংগ্রাম করতে হয়েছে রাজুকে। হয়তো রাজুদের পরিবারের গল্পও আর দশটা পরিবারের মতোই। ধার করে বড়ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছিল শহীদ পরিবার। যে কারণে মাথার ওপর ছিল পাহাড় সম ঋণের বোঝা। পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাঁশবাড়ি এলাকায় মেসে থাকতেন রাজু। ছোটখাটো কাজ করে নিজের লেখাপড়া এবং সংসারের খরচে শামিল হওয়ায় ছিল তাঁর কাজের উদ্দ্যেশ্য। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বড়ভাইয়ের মতো প্রবাস যাওয়ার। সংসারে সবার মুখে হাসি ফোটানো যার প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল, ঘাতকের বুলেট সেই চেষ্টাকে ক্ষতবিক্ষত করে দুমড়ে মুচড়ে দিল। সকল সোনালী স্বপ্ন মুহূর্তে ফিকে হয়েছে আজ। কে করবে স্বৈরাচারীর বিচার? কে দাঁড়াবে অসহায় পরিবারের পাশে? ২৪ এর আন্দোলন শহীদ রাজুর দিন যেন কোনো রকমে কেটে যায়। এরমধ্যে শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। পরে যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। এ গণ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক দফায় গিয়ে ঠেকে। রাজধানী ঢাকা তখন উত্তাল। সাধারণ মানুষের মনে ছাইচাপা আগুন। ছাত্র-জনতা বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত থাকা বারুদ। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় নানারকম স্লোগানে স্লোগানে। চারিদিকে মুখরিত হয় বিপ্লবী সব হুংকার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজু ছিলেন তৎপর। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে আন্দোলনে অংশ নিতেন তিনি। একপর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনে রূপ নেয়। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ আবু সাঈদকে নির্মমভাবে গুলি করে মারার পর কেউ আর তখন ভয় পায় না রাজপথে দাঁড়াতে। বুক পেতে দেয় ঘাতকের বুলেটের সামনে। ১৬, ১৭ তারিখ নাম না জানা অনেককেই গুলি করে মারা হয়। ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁরা জানায় কিছুতেই এ আন্দোলন শুধু মাত্র কোটার আন্দোলন হতে পারে না। তাহলে শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে। ১৮ তারিখ রাত থেকে সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় হাসিনা সরকার। কাপুরুষ পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নাটকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ১৯ জুলাই, শুক্রবার; কারফিউ ঘোষণা করে খুনি হাসিনা। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া পুরো দেশ তখন বিচ্ছিন্ন। কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। কেউ কারো খবর জানে না। ঐদিন রাজু কালো পাঞ্জাবি গায়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সাথে ছিল তাঁর মেসের চার বন্ধু। ঘড়িতে তখন বিকাল চারটা। মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য রাস্তায় হাঁটছিলেন রাজু। পুলিশের গাড়ি দেখে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়ানো শুরু করেন। অন্যরা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছালেও রাজু পারেননি। খুনী হাসিনার ঘাতক পুলিশ প্রথমে রাজুর পায়ে গুলি চালায়। পায়ে গুলি লাগার সাথে সাথে রাজু রাস্তায় পড়ে যান। আহারে! তখনও ঐ নির্মম নিষ্ঠুর বাহিনীর মনে কোনো দয়া হয় নি। পুলিশ কাপুরুষের মতো রাজুর কাছে এসে পেটে গুলি করে। মারাত্নক আহত হয়ে রাজপথে পড়ে ছিলেন রাজু। ঘাতক পুলিশ চলে গেলে রাজুর বন্ধুরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় রাজুকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তির পরই কর্তব্যরত চিকিৎসক রাজুকে মৃত ঘোষণা করেন। ‘বিদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট ভিসার বদলে রাজুর কবরের এপিটাফ তৈরী হয়।’ স্বপ্নের মৃত্যু সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ফোন করে রাজুর শহীদ হওয়ার খবর জানানো হয় তাঁর বাবাকে। রাজু হয়তো প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে বাড়িতে কথা বলতেন। ১৯ জুলাইও প্রিয় রাজুর ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলেন রাজুর মা-বাবা। ফোনকল এসেছিল ঠিকই। ফোনকলটা বয়ে নিয়ে এসেছিল রাজুর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। সে রাতেই ঢাকা গিয়ে শহীদ রাজুর লাশ গ্রহণ করে তাঁর ভগ্নিপতিসহ অন্য স্বজনেরা। ২০ জুলাই সকালে জানাযা শেষে মাগুরা জেলার আজমপুর চরপাড়া পারিবারিক কবরস্থানে রাজুর শেষ ঠিকানা রচিত হয়। হায়রে জীবন! বিদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট ভিসার বদলে রাজুর কবরের এপিটাফ তৈরী হয়। কিন্ত রাজুরা মারা যান না কখনোই। শহীদ রাজু বেঁচে থাকবেন আমাদের শ্রদ্ধায়, স্বাধীনতায়, দেশের প্রতিটি মুক্ত বাতাসে, জনতার স্বাধীন নিঃশ্বাসে। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: রাজু আহমেদ পেশা : ছাত্র প্রতিষ্ঠান : আদর্শ কলেজ, মাগুরা পিতা : আবুল কালাম মোল্লা (৬০), কৃষক মাতা : নাসিমা খাতুন (৫৮), গৃহিণী বয়স : ২৪ জন্মস্থান : মাগুরা মৃত্যু : ১৯. ০৯. ২০২৪, বিকাল ৪.০০টা মৃত্যুর কারণ : পুলিশের গুলিতে কবর : আজমপুর চরপাড়া কবরস্থান, সদর থানা, মাগুরা মৃত্যুর স্থান : মোহাম্মদপুর পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৬ জন প্রস্তাবনা ১. পরিবারকে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদের পিতাকে কৃষি কাজের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করা যেতে পারে