জন্ম তারিখ: ৪ ডিসেম্বর, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান: কাজলা
২০০৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানী শহরে জন্মগ্রহণ করেন শহিদ তায়িম ভূঁইয়া। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের আদরের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। চারিত্রিক মাধুর্যতা এবং ব্যাক্তিজীবনের চালচলনে ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। মাধ্যমিক শেষ করে ২০২২ সালে আদমজী নগর এম ডব্লিও কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তাঈম। শাহাদত বরণ করার পূর্বে দ্বাদশ শ্রেণির বানিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। জীবনে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। শহীদ পিতা বাংলাদেশ পুলিশের একজন সৎ অফিসার। এস আই পদে কর্মরত রয়েছেন। তাঁর মা চিরচারিত বাঙ্গালি বধূ। সংসারের সকল কাজ নিজ হাতেই করেন। যাকে বলা হয় গৃহিনী। তাঈমের বড় দুই ভাই দেশ এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে লেখাপড়া করছেন। গত ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সরকার কারফিউ জারি করে। ওইদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। সে সময় তাঈম ও তাঁর দুই বন্ধু একসঙ্গে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় চা খেতে যায়। যাওয়ার সময় তায়িম তাঁর বন্ধুকে বলে চা খাওয়া শেষ করে আমরা আন্দোলনে যাব। এরপর চায়ের দোকানে গিয়ে চা হাতে দুজনে গল্প করতে থাকে। কাজলা তখন উত্তাল। চারিদিকে ছাত্র আন্দোলনের তীব্র রণ হুংকারে আন্দোলিত হয় চারপাশ। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও ঘাতক পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র- জনতার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে তৎকালীন যাত্রাবাড়ীর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যথাক্রমে ইকবাল হোসেন, শামীম, তানজিল আহমেদ প্রমুখের নির্দেশে ওয়ার্ড কর্মী জাকির হোসেন ও তার সঙ্গীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, ছররা গুলি চালায়। প্রাণ ভয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা হন্য হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। তাঈম ও তাঁর দুই বন্ধু লিটন চা স্টোরের ভেতর ঢুকে দোকানের সাটার টেনে দেয়। সাটারের নিচের দিকে আধা হাত খোলা ছিল। ভিতরে অবস্থানরত সকলকে পুলিশ টেনে বের করে। ক্যাডার জাকির হোসেন গুলি থেকে বাঁচতে চাইলে দৌড় দিতে বলে। প্রাণে বাঁচতে শহীদ তায়িম সবার আগে দৌড় দেয়। জাকির হাসতে হাসতে তাঁর উপর গুলি চালায়। সন্ত্রাসীরা চারপাশে ঘিরে রাখে। কেউ উদ্ধার করতে যাওয়ার সাহস করতে পারেনা। বিনা চিকিৎসায় রাস্তার উপর শাহাদত বরণ করেন শহীদ ইমাম হোসেন তায়িম। কয়েকজন জোর করে হাসপাতালে নিতে যায়। তাঁদেরকে শাসিয়ে জাকির জানায়- সাহস থাকলে সামনে আয়। অতঃপর মানুষরূপী জানোয়ার নরপিশাচ জাকির ও তার রক্তখেকো আওয়ামী পেটুয়া বাহিনী সেখান থেকে গেলে স্থানীয় জনতা শহীদের লাশকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। শহীদের মোবাইল থেকে এস আই পিতার মুঠোফোনে হাসপাতাল কর্মী ঘটনার বিবরণ জানায়। ছেলের মরদেহে গুলি দেখার পর মোবাইলে একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে স্যার’। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুলেটের আঘাতে তছনছ শহীদ তায়িমের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ছিলো। স্বপ্ন দেখতেন পছন্দের সাবজেক্টে দেশের বাইরে পড়তে যাবেন। সে অনুযায়ী ফ্রান্সের ভিসা ও পাসপোর্ট রেডি করেছিলেন। কিন্ত বর্বর হাসিনার পালিত দেশদ্রোহী গুন্ডা জাকির ও তার দলবলের বুলেট সকল স্বপ্ন মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায় শহীদ ইমাম হোসেন তায়িমের। পাসপোর্ট ভিসা রেডি থাকলেও ঘাতকের গুলি কেড়ে নিল মেধাবী এই শিক্ষার্থীর জীবন। পাগলপ্রায় মা শহীদ তায়িমের বাবা পুলিশ কর্মকর্তা। ঢাকা জেলাস্থ যাত্রাবাড়ীর রসুলপুর এলাকায় স্ব-পরিবারকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। শহীদ পুত্রকে হারিয়ে তাঁর মা জননী আজ পাগলপ্রায়। তিনি বলেন, “আমার ছেলে আমার হাতের বানানো রুটি খেয়ে বের হয়। কিছুক্ষণ পর আমার কাছে খবর আসে, আমার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। তাকে ওরা টার্গেট করে হত্যা করেছে। আমার ছেলে প্রতিদিন ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিত। আমার ছেলে অনেক মেধাবী ছিল। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করা। যারা আমার ছেলেকে মেরেছে, তাদেরকে সবাই চেনে। আমি তাদের ফাঁসি চাই।” “একটা ছেলেকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার?” কোটা আন্দোলন চলাকালীন এই শিরোনামের নিউজটি সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়। নিচে নিউজটি হুবহু তুলে ধরা হলো- গত শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপপরিদর্শক ময়নাল হোসেন ও তার স্ত্রী। তাদের হাতে ছিল ১৭ বছরের ছেলে ইমাম হোসেন তাঈমের একটি ছবি। যাকেই পাচ্ছিলেন ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, এই ছেলেকে তারা কি কোথাও দেখেছেন? বিকেল ৫টা থেকে পরের দুই ঘণ্টা তারা হতাহতদের তালিকায় তাঈমের নাম খোঁজেন। পরে ছবি দেখে একজন সাংবাদিক তায়িমের বাবাকে মর্গে খোঁজ নিতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বিভাগের লাশঘরের উদ্দেশে দৌড় দেন তিনি। একজন লাশঘরের দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢোকেন তারা। সেখানে পড়ে ছিল রক্তে ভেজা ছররা গুলিবিদ্ধ তাঈমের নিথর দেহ। ছেলের মরদেহ দেখে স্তব্ধ হয়ে যান ময়নাল হোসেন। তার স্ত্রী মেঝেতে পড়ে মূর্ছা যাওয়ার আগে চিৎকার করে বলছিলেন, 'ও আল্লাহ! আমার পোলারে কে মারল! তুই আমারে না বইলা কেন বাইর হইছিলি?’ কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে কলেজ শিক্ষার্থী তায়িম শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে তাদের যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এর আগে তিন দিন ধরে যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষ চললেও তায়িমকে ঘরে আটকে রাখা যায়নি। ঘণ্টাখানেক পর তাঈমের বাবা-মাকে কেউ ফোন করে জানায় যে তাদের ছেলেকে গুলি লেগেছে; তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ময়নাল বলেন, 'কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে আমার ছোট ছেলে তাতে যোগ দেয়। তাকে শুরু থেকেই না করেছিলাম আন্দোলনে যেতে। কারফিউয়ের মধ্যে তাকে বের হতেও না করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনেনি।' মর্গে তাঈমের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর ফোনে ময়নালকে বলতে শোনা যায়, 'স্যার, আমার ছেলেটা মারা গেছে। বুলেটে ওর বুক ঝাজরা হয়ে গেছে। স্যার, আমার ছেলে আর নেই।' তিনি প্রশ্ন রেখে তাকে বলেন, 'একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে স্যার?' ছেলে গুলিবিদ্ধ জানিয়ে ঊর্ব্ধতন কর্মকর্তার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলেন ময়নাল। ফোনে কথা বলার সময় অপর প্রান্তে কে ছিলেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।-ডেইলি স্টার এক নজরে শহীদের তথ্যাবলি নাম : মো: ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ০২/১২/২০০৪,২০ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার, আনুমানিক দুপুর ১২.৩০ টা শাহাদাত বরণের স্থান : কাজলা দাফন করা হয় : গ্রামের বাড়ির কবরস্থান কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক২৭'০০.৮"ঘ ৯১ক্ক০০'০০.৪"ঊ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: এতবার পুর, থানা/উপজেলা: চান্দিনা, জেলা: কুমিল্লা পিতা : মো: ময়নাল হোসেন ভুইয়া মাতা :মোসা: পারভীন আকতার ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : গ্রামে একটি সেমিপাকা বাড়ি আছে ভাইবোনের বিবরণ : বড় দুই ভাই রয়েছে। তারা দুজনই পড়াশোনা করে