জন্ম তারিখ: ৫ জুন, ১৯৬৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: দিন মজুর, শাহাদাতের স্থান : মুগদা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল
আউয়াল মিয়া ৫ জুন সোমবার কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার যাত্রাপুর ইউনিয়নের মোচপাড়া গ্রামে ১৯৬৭ খ্রি: জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মৃত মোহর আলী। মাতা মৃত আনোয়ারা বেগম। তিনি বাল্যকাল থেকে হত দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠেন। শহীদের পরিবারে স্ত্রী, ছয় কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রয়েছে। ছয় মেয়েকে অত্যন্ত ভালবাসতেন আওয়াল মিয়া। মেয়েদেরকে বলতেন- তোমরা আমার সবচেয়ে প্রিয়। তোমাদের সাথে একত্রিত মুহূর্ত পরিবারের জন্য সবচেয়ে মহামূল্যবান। ছোট মেয়ে আফসানা বলেন- ‘বাবা শহীদ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সাথেই থাকতেন। প্রতিবার খাওয়ার সময় আমার জন্য প্লেটে একটু হলেও খাবার রেখে বলতেন- ‘এইটা আমার মেয়ের জন্য। তুমি কি খেয়েছো জানিনা। আমার সামনে বসে একটু খাওতো মা। বাবা ছিলেন আমাদের পরিবারের জন্য একমাত্র অবলম্বন। আমরা ছয় বোন। সকলের জন্য বাবার অনেক মায়া ছিল। বাবা প্রায় বলতেন- আমি শেষ বয়সে যখন কাজ করতে পারব না, তখন আমার মেয়েরা আমাকে দেখবে। আমার ছেলে হাবিবকে তোমরা দেখে রেখ। মায়ের খেয়াল রেখ।’ পরিবারের একমাত্র আয় উপার্জেয় ব্যক্তি ছিলেন শহীদ আওয়াল মিয়া। শহীদ সম্পর্কে তাঁর প্রতিবেশী বলেন- ‘চাচা অনেক ভাল মানুষ ছিল। রোদ বৃষ্টি শীত গরম কোন কিছু উপেক্ষা করতেন না তিনি। ভাল মানুষরা নাকি দ্রুত পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তারই হয়তো প্রমান শহীদ আওয়াল মিয়ার শাহাদত বরণ। ‘মহাজন বলেন- চাচা কাজের প্রতি ভীষণ দায়িত্ববান ছিলেন’ কর্মজীবন শহীদের আয় রোজগার বলতে দিন এনে দিন খাওয়া। আওয়াল মিয়া পেশায় রাজমিস্ত্রীর যোগালি ছিলেন। আজান হয়ে গেলে তাঁকে আর কাজ করানো যত না। শহীদ সম্পর্কে তাঁর মহাজন বলেন- চাচা কাজের প্রতি ভীষণ দায়িত্ববান ছিলেন। তবে ধর্মীয় ভাবে তিনি ছিলেন অনেক কঠোর। মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ চাচার কানে আসলে তাঁকে দিয়ে আমরা কাজ করাতে পারিনি। সাথে সাথে মসজিদে চলে যেত। শুক্রবার জুম্মার নামাজ থাকায় কোনভাবে কাজ করতেন না তিনি। আমি একবার পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে বলেছিলাম আপনাকে দিগুন-তিনগুন টাকা দেব। আজান হলে মসজিদে যেতে দেব। তবে তিনি রাজি হননি। আমাকে বলেছিলেন- শুক্রবারের দিন তুমি আমাকে একশ গুন টাকা দিলেও আমি কাজ করব না। কারণ- শুক্রবার মুমিনদের জন্য ঈদের দিন। ইবাদত বন্দেগী করার দিন। আমি এই দিন শুধুমাত্র মহান আল্লাহকে দিতে চাই।’ শহীদের পরিবারে আবাদি কোন জমি নেই। তবে স্বল্প পরিমাণে পৈতৃক বসতি জমি রয়েছে। যার উপর টিনের বেষ্টনী দিয়ে পরিবারের জন্য স্থায়ী নিবাস তৈরি করেছেন শহীদ আওয়াল মিয়া। পারিবারিক ভাবে তেমন স্বচ্ছলতা না থাকায় তারুণ্যের শুরুতে রাজধানী এসেছিলেন। মাঝে মাঝে সিমেন্টের দোকানে বস্তা বহনের কাজ করে বাড়তি উপার্জন করতেন। খুনি হাসিনা ও তার দলবল আদৌ কি কোনদিন মানুষ ছিলেন? না মানুষ হবেন? যেভাবে শহীদ হলেন শহীদ আউয়াল মিয়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। এক মাসের মাথায় তারা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায়। দীর্ঘ এক মাস ব্যাপক সহিংসতায় প্রায় ৮০০ জনের মৃত্যু হয়। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খুনি শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯ জুলাই শুক্রবার ২০২৪। আন্দোলন তখন প্রবল গতিতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খুনি হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আন্দোলন রুখে দিতে আরও বেশি তৎপর হয়ে উঠেপড়ে লাগে। চারিদিকে ভাঙচুর, ফায়ারিং, হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি ঘোলাতে করার প্রাণপণ চেষ্টা চালায় তারা। আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ঢাকার একটি মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয় আওয়ামী ক্যাডাররা। গণপরিবহন কর্তৃপক্ষের ভবন ভাঙচুরও করে তারা। ঐ দিন ঘাতক পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬৬ জন নিহত হয়। নরসিংদীর একটি কারাগার ‘দখল’ করে প্রায় ৯০০ বন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়, প্রায় ৮০ টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজারের বেশি রাউন্ড গোলাবারুদ লুট করা হয়। একপর্যায়ে স্বৈরাচার এর তাবেদারি পুলিশ ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী কতৃক সারা দেশে শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস ভাবে গুলাগুলি ও হত্যালিলা কার্যক্রম চালানো হয়। বিশেষ করে নরখাদক গুলো ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিক্ত হয়ে ছাত্র, মুসল্লি এবং আম-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়ে অলিগলি টহল দিতে দেখা যায় আওয়ামীলীগ বাহিনী নামের নরপিশাচদের। শহীদ আউয়াল মিয়া জুম্মার নামাজের পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাস্তায় হাটতে বের হয়। গুলাগুলি চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে কুতুবখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের টহল দেয়া দেখে ঘাবড়ে যান। খেয়াল করেন পুলিশ পাখির মত গুলি চালিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে হত্যা করছে। ঘড়িতে বেলা ৩ ঘটিকা। হঠাৎ শহীদকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে ঘাতক পুলিশ দূর থেকে গুলি চালায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই নরখাদকদের তিনটি গুলি আওয়াল মিয়ার শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। জীবনের ঝুকি নিয়ে আশে পাশের মানুষ তাঁকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় আওয়াল মিয়া বা তাঁর ছোট মেয়ে আফসানা কেউই বুঝতে পারিনি শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। প্রতিবেশীদের কথা শুনে ভেবেছিলেন শরীরে ছররা গুলি বিদ্ধ হয়েছে। যে কারণে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে প্রাথমিক সেবা নিয়ে নিজের বাসায় অবস্থান করছিলেন শহীদ আওয়াল। ধীরেধীরে তাঁর পেট ফুলে যায়। একপর্যায়ে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যাহত হলে ছোট মেয়ে ও তাঁর প্রতিবন্ধী জামাই নিকটস্থ ইউনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা তবুও শরীরে বিদ্ধ হওয়া গুলি চিহ্নিত করতে পারে না। এদিকে অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে ধাবিত হতে থাকে। সর্বশেষ আওয়াল মিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় মুগদা মেডিকেলে। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করে জানা যায় শরীরে বিদ্ধ হওয়া গুলিটি আওয়াল মিয়ার পেটেই রয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ায় অপারেশন করা বেশ কষ্টসাধ্য। পরিবার থেকে অনুমতিক্রমে শহীদকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। অপারেশনের পর প্রজ্ঞাবান দেশপ্রেমিক আওয়াল মিয়া বুঝতে পারেন তাঁর হাতে হয়তো আর বেশি সময় নেই। ছোট মেয়ে ও স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলেন- আমার একমাত্র ছেলে হাবিবকে (১৮) তোমরা দেখে রেখ। আমি হয়তো আর বাঁচব না। তাঁর অল্প কিছুক্ষণ পর চিকিৎসারত অবস্থায় ২১ জুলাই ২০২৪ খ্রি রোজ রবিবার সকাল ৬:৩০ টায় শহীদি কাফেলায় যোগ দেন মহাবীর, দেশপ্রেমিক তেজস্বী শহীদ মো: আওয়াল মিয়া। লাশ পরবর্তীতে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলায় পৌঁছে। সকলের অশ্রুসিক্তে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হন শহীদ আওয়াল মিয়া। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন কে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন শহীদ পত্নী ও তাঁর পুত্র হাবিব মিয়া। ঘাতকের গুলিতে নিভে গেল এক প্রজ্বলিত পরিবার প্রদিপ। কি নিষ্ঠুর ওরা! একজন সাধারণ বৃদ্ধকে হত্যা করে কি লাভ ওদের? ঘতাকদের অন্তরে কোন সহানুভূতি কি নেই! খুনি হাসিনা ও তার দলবল আদৌ কি কোনদিন মানুষ ছিলেন? না মানুষ হবেন? কেমন আছে শহীদে আউয়ালের মিয়ার পরিবার শহীদ আওয়াল মিয়াকে হারিয়ে তাঁর পরিবার এখন দিশেহারা। একমাত্র উপার্জন ক্ষম ব্যক্তি শহীদ হওয়াতে পরিবারটি এখন সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। একমাত্র ছেলে হাবিবের বয়স আঠারো বছর। সে এখনো কোনো কর্মে যোগ দিতে পারেনি। তার স্ত্রী বলেন, আমাদের পরিবারের আর কিছু বাকি রইল না। আমরা কি করে খাব? কিভাবে চলবো? বুঝতে পারছি না! এক নজরে শহীদ আওয়াল মিয়া নাম : আওয়াল মিয়া পেশা : দিন মজুর জন্ম তারিখ ও বয়স : ০৫-০৬-১৯৬৭ আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকাল ৩.০০ টা শহীদ হওয়ার তারিখ : ২১-০৭-২০২৪, সকাল ৬.৩০ শাহাদাত বরণের স্থান : মুগদা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল দাফন করা হয় : নিজ গ্রামে স্থায়ী ঠিকানা : মোচাগড়া, যাত্রাপুর, কুমিল্লা পিতা : মোহর আলী মাতা : আনোয়ারা ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : একটি টিনের বাড়ি আছে। অল্প ভিটা জমি আছে সন্তানের বিবরণ : ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েরা সবাই বিবাহিতা। একমাত্র ছেলে হাবিব (১৮) বেকার প্রস্তাবনা ১. শহীদ পুত্রকে কর্মসংস্থান করে দেয়া যেতে পারে। ২. শহীদ পত্নীকে মাসিক বা এককালীন সাহায্য করা যেতে পারে
আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা-প্রাপ্ত হয়ে থাকে। (সুরা আল-ইমরান ৩:১৬৯)
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হতে চায়, আল্লাহ তাকে শহীদের সাওয়াব দেন।” (সহীহ মুসলিম ১৮৮৯)

