জন্ম তারিখ: ৪ এপ্রিল, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : সাপ্লাইয়ার, শাহাদাতের স্থান : গোপীবাগ, ঢাকা
২০০১ সালে এপ্রিল ৪ তারিখে কুমিল্লার দেবিদ্বারের সুর্য্যপুরে জন্মগ্রহণ করেন সোহাগ মিয়া। মো: আলী ও নাসিমা বেগমের বড় সন্তান সোহাগ মিয়া। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা হারান তিনি। মা কষ্ট করে মানুষ করেন সোহাগ মিয়াকে। মায়ের অপারেশনের খরচ যোগান দিতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে কাজে লেগে যান তিনি। একটি কুরিয়ার সার্ভিসে সাপ্লাইয়ারের কাজ নেন সোহাগ। যেভাবে শহীদ হলেন আন্দোলনের সময় ঢাকায় অবস্থান করছিলেন শহীদ মো: সোহাগ। তার মা তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সে বলেও- মা, দুনিয়ার সব মানুষ মুক্তির জন্য জীবন দিয়ে দিতেছে। আমি কেন স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকবো। কারফিউ চলাকালীন মা তার জন্য বিকাশে ৫০০ টাকা পাঠায়। সে টাকা তোলার জন্য রাস্তায় বের হলে পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলির সামনে পড়ে যায়। একটি ঘাতক বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার বুকে। মুহুর্তেই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। লোকজন তাকে ঢামেকে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা দেয়। পরে লাশ আনতে গেলে তার মাকে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয় নানাভাবে। কেমন আছে তার পরিবার শহীদ মো: সোহাগ তার এক ছোট ভাই ও মায়ের সাথে কুমিল্লায় থাকত। সে একটা কুরিয়ার সার্ভিসে সাপ্লাইয়ারের কাজ করে পরিবার চালাতো। ছোট ভাই প্রেসে কাজ করে, অল্প বেতন পায়। মায়ের অপারেশনের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে অল্প বয়সেই কাজে নামতে হয় তাকে। সোহাগের বাবা মারা যায় ১০ বছর বয়সে। তাদের দুই ভাইকে মা একাই মানুষ করেন। গ্রামে থাকার জন্য একটা বাড়ি করে, সে বাবদ ২ লক্ষ টাকা ঋণ আছে। বড় সন্তানকে হারিয়ে নাসিমা বেগমের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ছোট ছেলের অল্প আয়ে পরিবার চালিয়ে ঋণ শোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ তাদের। শহীদ পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। ‘আমার কলিজার টুকরো ছেলেটা কই, আমার নিমাই চাঁনরে গুলি করে মারল কে? আমার বুকটা খালি করল কারা? তাদের কী একটুও বুক কাঁপল না! আমার ছেলেরে কেউ আইন্না দাও, আমি জড়াই ধরি। না জানি আমার সোনার চানের কত কষ্টে দম গেছে, আহারে কোন পাষণ্ড আমার নিরীহ ছেলেরে গুলি করল, আমার চিকিৎসার খরচ আর কে দিবে। আল্লাহ, তুমি আমার বুক খালি করে কলিজার টুকরো ছেলেরে কীভাবে নিলা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে।’ গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ঢাকায় গুলিতে নিহত সোহাগের মা নাছিমা বেগম। গত ২০ জুলাই রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালীন রাত ৮ টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন ২৪ বছরের সোহাগ। মা নাছিমা বেগম ছেলে সোহাগের ছবি দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ২২ বছর ধরে স্বামী নেই, সোহাগের যখন তিন বছর তখন আমার স্বামী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়, আর ফিরে আসেনি। সে এখনও বেঁচে আছে না মরে গেছে আমরা কেউ জানি না। তবুও আমরা ধরে নিছি তিনি আর বেঁচে নেই। স্বামী নিখোঁজের পর সংসারের হাল ধরতে সোহাগ ও দেড় বছরের সহিদুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেছি। পাঁচ বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। সোহাগ লেখাপড়া বন্ধ করে সংসারের হাল ধরে। ছোট ছেলে সহিদুল মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। অভাব অনটনে তার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়, সে এখন এক বই বাঁধাই কোম্পানিতে কাজ করে। তিনি চোখের পানি মুছেন আর বলেন, আমার চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরতে সোহাগ একটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিতে ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করত। গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে তার চাকরিটা চলে যায়। পরে নতুন আরেকটি কোম্পানিতে চাকরির কথা হয়। ১৫ জুলাই বাড়িতে এসে কাগজপত্র নিয়ে নতুন কোম্পানিতে জমা দেয়। এরপর ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোববার আমার ছেলের বুকে গুলি লাগে। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব আক্ষেপ করে নাছিমা বেগম বলেন, আমার ছেলে শেষবার আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘মা ঢাকায় অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে’ - এ কথা শুনে আমার বুকে কেঁপে উঠে। আমি বলি, বাবারে তুই রুম থেকে বের হইস না। ছেলে বলে, ‘না মা আমরা সব রুমমেট একসঙ্গে আছি, বের হইনি। তবে মা মেসে কোনো খাবার নেই, আমার কাছেও কোনো টাকা নেই, তুমি যদি পার আমার বিকাশে ৫০০ টাকা দিও। আর তুমি ঠিকমতো ওষুধগুলো খাইও।’ পরে আমি আমার ছেলের নম্বরে ৫০০ টাকা পাঠাই। ওই টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় নাশতা আনতে বের হয়। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইব। কেউ কি আমার ছেলেকে ফিরায় দিতে পারবে? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা। সোহাগের ছোট ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন, ভাই গুলি খাওয়ার পর তার বন্ধুরা আমাকে ফোনে জানায়। আমি রাত ৩ টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাই, গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকে ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে ভাই বলে, তুই এত রাতে এখানে কেনো আসছিস। তুই মাকে দেখে রাখিস। এই কথা বলে রাত ৩ টা ১৫ মিনিটের দিকে ভাই মারা যায়। ভাই আমাদের সংসার চালাত। বাবা ও ভাই হারিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম। নিহত সোহাগের চাচা এখলাছুর রহমান শানিক বলেন, ২২ বছর আগে সোহগের বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর তার মা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন। তার মা অসুস্থ হয়ে গেলে তার চিকিৎসার খরচ ও সংসারের হাল ধরে সোহাগ। নতুন একটি কোম্পানিতে চাকরির কথা চলছিল তার। দুই একদিনের মধ্যে সেখানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। ছোটবেলা থেকে বাবার আদর পায়নি ছেলেটা, অভাব অনটনে বড় হইছে। একটা গুলি এই পরিবারটাকে একবারে পথে বসিয়ে দিল। ভানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী জালাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ছেলেটা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সংসারটা সেই চালাত। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। তার পুরো পরিবার সম্পর্কে আমি খোঁজখবর রাখছি। সরকারিভাবে সোহাগের মাকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। এক নজরে শহীদ সোহাগ মিয়া নাম : সোহাগ মিয়া পেশা : সাপ্লাইয়ার জন্ম তারিখ ও বয়স : ০৪/০৪/২০০১, ০৯ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার, আনুমানিক বিকেল ৩ টা শাহাদাত বরণের স্থান : গোপীবাগ, ঢাকা দাফন করা হয় : সুর্যপুর, দেবিদ্বার, কুমিল্লা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম:সুর্য্যপুর, থানা/উপজেলা: দেবিদ্বার, জেলা: কুমিল্লা পিতা : মো: আলী মাতা : নাসিমা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : গ্রামে অল্প জমি আছে ভাইবোনের বিবরণ : এক ভাই। সে প্রেসে কাজ করে প্রস্তাবনা : ছোটভাইকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া : ঋন শোধের ব্যবস্থা করে দেয়া : শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান করা : শহীদের মায়ের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা