জন্ম তারিখ: ৪ মে, ১৯৮৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা:দোকানের কর্মচারী, শাহাদাতের স্থান: উত্তরা পশ্চিম থানা
১৯৮৩ সালের ৪ মে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের মানিকরাজ গ্রামে পিতা নূর মোহাম্মদ ও মাতা ফাতেমা বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম নেন শহীদ আবদুল কাদির। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। পরিবারের হাল ধরতে বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে আসেন কাদির। কাজ শুরু করেন একটি রড সিমেন্টের দোকানে। ধীরেধীরে উপার্জন বৃদ্ধি পায়। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর রাহিমা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের কোলজুড়ে জন্ম নেয় একটি ছেলে ও দুইটি মেয়ে সন্তান। স্ত্রী ও সন্তানদেরকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় সংসার পেতেছিলেন শহীদ আবদুল কাদির। যেভাবে শহীদ হলেন ৫ আগস্ট ২০২৪ পদত্যাগ করে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই খবর মুহূর্তে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশ বিজয় মিছিলে ছেয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় উত্তরায় একটি বিজয় মিছিলে যোগ দেন আবদুল কাদির। মিছিল শেষে বাড়ি ফেরার পথে উত্তরা পশ্চিম থানার সামনে খুনি হাসিনার রেখে যাওয়া ঘাতক পুলিশ বাহিনি নির্বিচারে গুলি চালায়। হঠাৎ একটি গুলি আবদুল কাদিরের মাথায় আঘাত হানে। মাথার খুলি ফেটে মগজ বেরিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান শহীদ আবদুল কাদির। রাস্তা থেকে লাশ তুলে স্তুপ করা হয় থানার সামনে। এদিকে স্বামীকে খুঁজে না পেয়ে হয়রান হন রহিমা খাতুন। দীর্ঘক্ষণ পর শহীদের বন্ধু মোস্তফা লাশ খুঁজে পান। এভাবে নিজের পরম প্রিয় বন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এরপর কাদিরের লাশকে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পৈতৃক গ্রামে জানাজা শেষে চির নিদ্রায় শায়িত হন শহীদ আবদুল কাদির। ‘বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়েছেন’ কেমন আছে শহীদ পরিবার শহিদ আবদুল কাদির ঢাকার উত্তরাতে একটি রড সিমেন্টের দোকানে কাজ করে নিজের পরিবার চালাতেন। স্বল্প উপার্জনে ছয় জনের পরিবার অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতেন। খুনি হাসিনার পুলিশ বাহিনীর বুলেটের আঘাতে রাস্তায় নেমেছে শহীদ পরিবারটি। ছোট ছোট অসহায় তিনটি বাচ্চা নিয়ে বিপদে পড়েছেন কাদির স্ত্রী রাহিমা বেগম। তাদের লেখাপড়া, ভরণ পোষন সবকিছু নিয়ে বেশ বিপাকে তিনি। বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে তিন সন্তানকে নিয়ে অনাহার-অনাচারে জীবন পার করছেন সদ্য বিধবা হওয়া শহীদ স্ত্রী রাহিমা খাতুন। ‘আমি খুনিদের ফাসি চাই’ প্রতিবেশীর অভিমত শহীদ আবদুল কাদির সম্পর্কে তার প্রতিবেশি মুহসিন অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে চোখ ভিজিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন- “আবদুল কাদির আর আমি অনেক ভালো বন্ধু ছিলাম। সে অনেক ভালো মানুষ ছিলো। সবার সাথে ভালো আচরণ করত। গ্রামের প্রায় সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিলো কাদিরের। এলাকাবাসী তাঁকে কখনও ভুলতে পারবে না। আমি তাঁকে নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়তে দেখেছি। আমার বন্ধু হত্যার বিচার চাই। অসহায় পরিবারটির পাশে এখন কে দাঁড়াবে! কে ছোট ছোট সন্তানগুলোর দায়িত্ব নেবে। আমি খুনিদের ফাসি চাই।” ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ২৪ এর আন্দোলন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১, ২০১৫, ২০১৮, ২০২৪ সবখানেই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ছিল। তবে ২০২৪ এর আন্দোলনের শহীদ ও গাজী শিক্ষার্থীদের প্রথমবারের মত যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন স্বৈরশাসক খুনি হাসিনা সরকারের বিপক্ষে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তাঁরা। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল তাঁরা। সে সময় স্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ তখন থেকেই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা গড়ে উঠেছিল বর্তমান জেনারেশনের। ন্যায় নীতিতে হয়ে উঠেছিল অবিচল। অন্যায় রুখে দিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল তাঁরা। সে সময় আরও কিছু স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। অন্যায়ের কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুড়িয়ে দাও।’ সর্বশেষ ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই শিক্ষার্থীরা। ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে আন্দোলনের দামামা বেজে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন ধীরেধীরে তরান্বিত হয়। আন্দোলনের শুরু থেকেই ঘাতক পুলিশ বাহিনী ও স্বৈরাচারী সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালাতে থাকে। ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষনা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠন। কর্মসূচী ভেস্তে দিতে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, ছড়রা গুলি, গুম, খুন, নির্যাতন, মামলা করে ছাত্র-জনতাকে হয়রানি করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালিত গুন্ডা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশীয় অস্ত্র ও রাইফেল নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আওয়ামীর দাগী সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘদিন আন্দোলন চলার ফলে ভীতি সঞ্চারিত হয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ কারফিউ ঘোষণা করে তৎকালীন খুনি শাসক শেখ হাসিনা। সেই কারফিউ ভেঙে রাজধানীর অলিগলিতে অবস্থান নেয় আপামর ছাত্র-জনতা। এরপর বেলা দুইটায় গণমাধ্যমে খবর আসে, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। ঢাকার রাজপথসহ সারাদেশে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা একে অপরকে ধরে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন। এক নজরে শহীদ আবদুল কাদের নাম : আবদুল কাদির পেশা : দোকানের কর্মচারী জন্ম তারিখ ও বয়স : ৪ মে ১৯৮৩, ৪১ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, আনুমানিক বিকেল ০৪.০০ টা শাহাদাত বরণের স্থান : উত্তরা পশ্চিম থানা দাফন করা হয় : মানিকরাজ,ফারিদগঞ্জ , চাঁদপুর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মানিকরাজ , থানা/উপজেলা: ফারিদগঞ্জ, জেলা: চাঁদপুর পিতা : নুর মোহাম্মদ মাতা : ফাতেমা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : কোনো সম্পদ নেই সন্তানদের বিবরণ : ছোট একটি ছেলে ও দুইটি মেয়ে রয়েছে প্রস্তাবনা ১. শহীদ সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দেয়া যেতে পারে ২. শহীদ পরিবারে মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে