জন্ম তারিখ: ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ইলেকট্রিশিয়ান শাহাদাতের স্থান: সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জ
শহীদ পরিচিতি জুলাই’২৪ এর মহান আন্দোলনের অন্যতম একজন বীর যোদ্ধা শহীদ ফয়েজ (৩৩)। যার তেজস্বী হুংকারে ভেঙ্গে পড়ে তৎকালীন স্বৈরাচারীর মসনদ। গল্পের অধিকর্তার জন্ম ১৯৯১ সালের ০৭ সেপ্টেম্বর। যুবক ফয়েজ প্রমাণ করে গিয়েছেন সবার আগে নিজের দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। জালিমের খবরদারি থেকে নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও মাতৃভূমিকে স্বাধীনতার শুধা পান করাতে হবে। ২০০৮ সালে স্বৈরাচার শাসক ক্ষমতায় আসার পর থেকে সুজলা সুফলা স্বাধীন এই দেশটিকে ধাপেধাপে প্রতিবেশী ঘাতক রাষ্ট্র ভারতের কাছে প্রায় বিক্রি করে দিয়েছিল। নিজের পেশিশক্তি ব্যবহার করে ভূরাজনৈতিক অবস্থাকে চরম উত্তাল করে অট্টহাসিতে মেতেছিল খুনি হাসিনা ও তার দোসররা। জন্ম পরিচয় শহীদ জনয়িতা জনাব আলা উদ্দিন বেপারি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। বয়স বাষট্টি হলেও বার্ধক্য তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। অপরদিকে তেজস্বীর জননী বীরমাতা ছবুরা বেগম (৫০) পুরাদস্তুর গৃহিণী। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তিনি নিজ হাতেই পালন করেন। শহীদ পরিবার পূর্ব থেকেই নিম্নবিত্ত। যে কারণে সংসার জুড়ে দীনতা লেগেই থাকে। টানাপড়েনের নিমিত্তে মেধাবী হওয়া সত্বেও লেখাপড়া হয়নি দেশমাতার অনুপম শহীদ ফয়েজের। পেশা যখন দায়িত্ব অভাব-অনটনে শৈশবেই দায়িত্ব বর্তায় শহীদ ফয়েজের উপর। বিদ্যাপীঠকে বিদায় বলায় অন্তরস্থলে পাহাড়সম হতাশা ও ক্ষোভ জমাট বাঁধে। তবুও শহীদ যেন থামতে জানেন না। শিশু বয়সে পরিবারের হাল ধরতে বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বিয়োগের দীক্ষা অর্জন করেন তিনি। ধীরে ধীরে পরিবারে দীপ্তির দেখা মেলে। শহীদের উপার্জিত অর্থকড়ি থেকে একমাত্র বোন তাহমিনার (২৮) বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং একোদর জোবায়েরকে (২৪) পেশাগত ভাবে দর্জির কর্মসাধনেও ফয়েজের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জীবনের একাকীত্ব দূর করতে প্রাণবন্ত ফয়েজ (৩৩) সুহাসিনী নুরুন্নাহার বেগমের (৩৫) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরপর তাঁদের কোল জুড়ে জন্ম নেয় এক দস্যি বালক। পরম আদরে তার নাম রাখা হয় রাফি (২)। সন্তানের উষ্ণতা যেন মুগ্ধ ভাবে অনুভব করেন এই দম্পতি। সংসার জুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। বাবা-মায়ের পরম স্নেহে শহীদ পুত্র দ্রুত বড় হতে থাকে। সন্তানকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন শহীদ ফয়েজ। প্রিয়তমা স্ত্রী কে বলেন- ‘আর্থিক সংকুলান না থাকায় আমার লেখাপড়া হয়নি। আমি চাই না আমার সন্তানেরও এমন কিছু হোক। রাফিকে আমি মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। পরিবারের কায়ক্লেশ কোনভাবেই যেন তাকে আচ্ছাদিত করতে না পারে। উপর্যুক্ত কথাগুলো প্রমাণ করে শহীদের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার জ্ঞানভাণ্ডার কতটা সমৃদ্ধ ছিল! এতকিছুর পরও দায়িত্ববান পিতা সন্তানকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যে মানুষটি এতদিন পরিবারকে একা একহাতে রক্ষণাবেক্ষণ করে গিয়েছেন। বুক চিতিয়ে পরিবার থেকে দীনতা দূরীভূত করেছেন। সেই বাস্তববাদী সত্যের পথে অবিচল থাকা মহাপুরুষটি নিজের জীবনকে পরওয়া না করে ঠিকই দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে গেলেন। যেভাবে তিনি শহীদ হলেন শহীদ ফয়েজ স্বৈরাচার সরকার পতনের লক্ষে ২১ জুলাই ২০২৪ ছাত্র জনতার মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিলটি রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় শুরু হয়ে যাত্রবাড়ী অভিমুখে রওনা করে। সামান্য পথ অতিক্রম করাকালীন হঠাৎ ঘাতক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার, র্যাব, স্বৈরাচার আওয়ামীর দোসর, পেটুয়া বাহিনী মিছিলকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। ক্ষমতার সবচেয়ে অপব্যবহার করে নরপিশাচ খুনি হাসিনার মদদপুষ্ট নরপশু র্যাব নামক মানুষখেকো বাহিনী। মিছিলকে উদ্দ্যেশ্য করে উপর থেকে হেলিকপ্টার যোগে উপর্যুপরি গুলি বর্ষণ করে তারা। আকস্মিক কয়েকটি গুলি ফয়েজের মাথা ও ঘাড়ে এসে বিদ্ধ হয়। অবশ নিথর দেহ ও ঘোলাটে চোখে ধীরেধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘাতক সরকারের বলি হয়ে প্রিয় সন্তানের স্বপ্ন পুঞ্জিভূত করে পড়ে থাকে তাঁর নিথর দেহটি। আবছা হয়ে আসা দৃষ্টি শক্তিতে শেষ বারের মত স্নেহের সন্তানের মায়ামুখ কল্পনা করেন। অনুমানে হাত বাড়িয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে ছুঁয়ে দেখার সর্বশেষ চেষ্টা করেন। ঠিক সে মুহূর্তে ঘাতকের আরেকটি গুলি বিকট শব্দে তাঁর শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। ফলে ঘটনা স্থলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন দেশমাতার প্রিয় সন্তান শহীদ বীর ফয়েজ। চোখের সামনে এই আত্মত্যাগ দেখে পথচারীরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শহীদের প্রাণদানে রচনা হয় বাঙ্গালীর নব্য ইতিহাস। যেন শহীদের রক্ত ছুঁয়ে আপামর জনতা শপথ নেয়! বীর দর্পে কণ্ঠ চেপে ধরে খুনি হাসিনার। তীব্র আন্দোলনে ফেটে পড়ে সারাদেশের জনতা। একপর্যায়ে ভঁয়ে জড়সড় হয়ে ছাত্র জনতার রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে পলায়ন করে ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনা। তার রেখে যাওয়া মসনদকে পায়ের ধুলিতে পরিণত করে এ দেশের বীর জনতা। একনজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : শহীদ ফয়েজ জন্মতারিখ ও বয়স : ০৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯১, ৩৩ বছর পেশা : ইলেকট্রিশিয়ান পিতা : জনাব আলা উদ্দিন বেপারী মাতা : ছবুরা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : বেপারিবাড়ি, উত্তরচর আবাবিল, রায়পুর, লক্ষীপুর শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ২১ জুলাই ২০২৪, সন্ধ্যা ০৬ টা, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জ যাদের আঘাতে শহীদ : পুলিশ ও র্যাব শহীদের কবরস্থান : নিজ এলাকায় স্ত্রী : মোসা: নুরুন্নাহার (৩৫) ছেলে : মো: রাফি, বয়স: ০২ প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারে মাসিক সহযোগিতা দেওয়া যেতে পারে। ২. শহীদের পুত্রকে এতিম সন্তান লালন-পালন প্রকল্পের আওতাধীন করা যেতে পারে। ৩. শহীদ পত্নীকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া যেতে পারে।