জন্ম তারিখ: ১৪ জুলাই, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : ফেক্টরি শ্রমিক, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে
শহীদ আশিক মিয়া একটি নাম, একটি সংগ্রামের প্রতীক, এবং এক হৃদয়বিদারক ইতিহাসের অংশ। ১৪ জুলাই ২০০৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার গকুল নগরের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন আশিক। ছোট্ট গ্রাম, মেঠো পথ, সবুজ মাঠ আর দুরন্ত শৈশব ঘিরে ছিল তার জীবন। কিন্তু শৈশবের আনন্দময় দিনগুলো দ্রুতই পরিণত হয় কঠিন বাস্তবতায়, যখন দারিদ্র তার জীবনকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরতে থাকে। অভাবের তাড়নায় কৈশোরেই তার কাঁধে ভর করে পরিবারের ভার। নিজেকে হারিয়ে ফেলে না আশিক, বরং এক গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। শৈশবের সেই আকাশ সমান স্বপ্ন, গ্রামের বাতাসে মিশে থাকা মুক্তির গান, তাকে ধীরে ধীরে পরিণত করে একজন সংগ্রামী যুবকে। পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ব ছিল বড়, কিন্তু তার চেয়েও বড় ছিল দেশের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। দারিদ্রের কষাঘাত সত্ত্বেও, আশিক থেমে থাকেনি। কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করলেও তার হৃদয়ের গভীরে ছিল স্বাধীনতার তৃষ্ণা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার। দেশের মানুষ যখন নির্যাতিত, ছাত্ররা যখন রাস্তায় নামলো অবিচারের বিরুদ্ধে, আশিকও তাতে সামিল হলো। তার কাজের চাকরী কিংবা দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম তাকে থামাতে পারেনি। প্রতিদিনের কষ্টসাধ্য জীবনেও সে অবিচল ছিল একটি আদর্শের পেছনে দেশের জন্য, মানুষের জন্য। কিন্তু সেই সংগ্রামের এক পর্যায়ে, তার জীবন থেমে গেলো। পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়লো এই তরুণ, যে শুধুমাত্র একটি ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল। তবে তার মৃত্যু শুধু একটি জীবনের শেষ নয়, এটি একটি আন্দোলনের নতুন শুরুও বটে। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ আশিক মিয়ার পরিবার আজও বেদনা ও হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত। আশিকের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রায় এক দশক পূর্বে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন, সন্তানদের এতিম এবং স্ত্রীকে বিধবা করে অনন্তকালের পথে পাড়ি জমান। আশিক শহীদ হওয়ার পর এখন বাড়িতে শুধুমাত্র তার মা ও দাদি রয়েছেন, যাদের জন্য জীবনযুদ্ধ যেন প্রতিদিনের অপরিহার্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরিবারের ভার এখন ১৯ বছর বয়সী ছোট ভাইটির কাঁধে। বর্তমানে তিনি সৌদি আরবে শ্রমিকের কাজ করছেন, কিন্তু তার সামান্য আয়ে পরিবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন পার করছে পরিবারটি। তাদের একমাত্র অবলম্বন হলো পৈতৃক ভিটেমাটি, যা আজ তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এই বাড়ি ছাড়া তাদের আর কোনো জমি-জমা নেই। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি প্রতিবেশী মুহাম্মদ ইসমাইল স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আশিক ছিল সত্যিই এক অনন্য সজ্জন। তার মধ্যে এক সরলতা ও মাধুর্য ছিল যা তাকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল। এমন চরিত্রবান ও সৎ মানুষেরাই আল্লাহর নিকট প্রিয়ভাজন হয়। আশিক কখনও কারো সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াতো না, সবসময় শান্ত ও নম্র থাকতো। ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সে ছিল নিয়মিত ও নিষ্ঠাবান, প্রতিটি নামাজে তার উপস্থিতি ছিল অবিচল।" শাহাদাতের বর্ণনা আশিক মিয়া—একটি সাধারণ নাম, কিন্তু তার সংগ্রামী জীবন আমাদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে অমর হয়ে থাকবে। একদিকে ছিলেন তিনি একজন সরল, অনাড়ম্বর কারখানা শ্রমিক, অন্যদিকে ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অজেয় যোদ্ধা। নারায়ণগঞ্জ জেলার কাচপুর এলাকার একটি কার্টুন ফ্যাক্টরিতে কাজ শিখছিলেন তিনি, সেখানে প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি নীরবে নিজেকে গড়ে তুলছিলেন একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্যে। তার জীবিকার প্রয়োজনে কারখানায় শ্রম দিতে বাধ্য হলেও, তার অন্তরে জ্বলে উঠেছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগণিত সাহসের প্রদীপ। বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে তার অবিচল অংশগ্রহণ ছিলো তার ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। তিনি স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে চলমান দুঃশাসন, অন্যায়, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ করতেন। হাসিনার স্বৈরাচারী নীতির কারণে সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। মানুষ যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত হচ্ছিল, তখন সরকার দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছিল। শহীদ আশিক নিয়মিত এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করে আসছিলেন, যার ফলে সরকার তার প্রতি গভীর শত্রুতা পোষণ করছিল। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, তার জীবনের সেই শেষ দিনটিতে, কাচপুর ব্রিজের কাছে পুলিশ যখন নির্মমভাবে আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ করে, আশিকও সেই আঘাতের মুখোমুখি হন। বিকাল ৫:৩০ মিনিটে পুলিশের বুলেট তার শরীরে বিদ্ধ হয়, আর সেই মুহূর্তে তার সাহসী হৃদয় তাকে ত্যাগ করলেও তার আত্মা প্রতিরোধ করতে জানতো না। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় রাত ২টায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আশিকের জীবন আর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ৫ আগস্ট সকাল ১০ টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শহীদ আশিকের মৃত্যুতে তার পরিবার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তারা জানত, তিনি একটি অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার অগাধ সাহস এবং ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগ আজ লাখো তরুণের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বর্বরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে তার মৃত্যু, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনো আত্মত্যাগই বৃথা যায় না। আশিক মিয়ার চলে যাওয়া যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি তা আমাদের সকলের জন্য এক উদাহরণ। শহীদ আশিক সেই সংগ্রামী তরুণ, যার সাহসী প্রতিবাদ আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে কেবল ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অটল সাহস এবং নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ। শহীদ আশিক একটি প্রেরণার বাতিঘর আশিক মিয়া একজন সাধারণ কারখানা শ্রমিক হলেও তার সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার অটল অবস্থান প্রমাণ করেছে যে, জীবিকার প্রয়োজনীয়তা তার মনোবলকে দুর্বল করতে পারেনি। প্রতিদিনের ছোট্ট সেই চাকরি হয়তো তার জীবিকার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আশিকের হৃদয়ে ছিল দেশের জন্য অগাধ ভালোবাসা। তার মধ্যে ছিল না কোনো বড় চাকরি বা উচ্চাভিলাষের বাসনা। শুধু পরিবারকে সহায়তা করার চিন্তা তার মনকে পূর্ণ করেছিল। কিন্তু যখন দেশের মানুষ বৈষম্যের শিকার হলো, যখন ছাত্ররা রাস্তায় নামলো স্বাধীনতার জন্য, আশিক আর চুপ থাকতে পারেননি। তিনি শ্রমিকের জীবন ছেড়ে যোগ দিলেন আন্দোলনে। প্রতিদিন কাজ শেষে তিনি নেমে পড়তেন ছাত্রদের পাশে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেন সাহসিকতার সাথে। এ সংগ্রাম তার কাছে ছিল ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতির স্বাধীনতার জন্য এক পবিত্র দায়িত্ব। একদিন পুলিশের গুলিতে ঝরে গেলো তার প্রাণ। একজন কারখানা শ্রমিককেও ক্ষমতাসীনদের বর্বরতা থেকে রেহাই দেওয়া হলো না। কিন্তু আশিকের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়নি। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাখো তরুণের হৃদয়ে জ্বলে উঠলো আন্দোলনের আগুন। তিনি শুধু একজন শহীদ নয়, আমাদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। তার সাহসিকতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জাতির প্রয়োজনে কোনো স্বপ্নই তুচ্ছ নয়, আর কোনো আত্মত্যাগই বৃথা যেতে পারে না। একনজরে শহীদ আশিক মিয়া নাম : আশিক মিয়া জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৪/০৭/২০০৭ , ১৭ বছর পেশা : ফেক্টরি শ্রমিক স্থায়ী ঠিকানা : গকুল নগর, দড়িয়াকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিতা : কামাল মিয়া মাতা : কুসুম বেগম পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৫ জন ১. রেজিনা আক্তার, ২৬ বছর, বিবাহিত, সম্পর্ক-বোন ২. লিজা আক্তার, ২২ বছর, বিবহিত, সম্পর্ক-বোন ৩. ইমরান মিয়া-১৯ বছর, প্রবাসী, সম্পর্ক-ভাই আহত হওয়ার স্হান : কাচপুর ব্রিজ আক্রমণকারী : সশস্ত্রবাহিনী আহত হওয়ার তারিখ : ০৪ আগস্ট ২০২৪ শাহাদাত বরণের স্থান ও তারিখ : রাত ২ টায় তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ৫/০৮/২৪ তারিখ সকাল ১০ টায় মারা দাফন করা হয় : নিজ গ্রামে কবরের জিপিএস লোকেশন : প্রস্তাবনা সমূহ ১. বাসস্থান প্রয়োজন ২. প্রবাসী ভাইটির জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে ৩. ছোট ভাই-বোনদের লেখা-পড়ার খরচ যোগানে সগযোগীতা করা যেতে পারে