Image of মো: রফিকুল ইসলাম

নাম: মো: রফিকুল ইসলাম

জন্ম তারিখ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০০০

শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: প্লাস্টিক কোম্পানীর কর্মচারী, শাহাদাতের স্থান: চিটাগাং রোড

শহীদের জীবনী

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার সবুজ শ্যামল গ্রাম থোল্লাকান্দি—যেখানে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে সবুজের অরণ্য। এই শান্ত গ্রামে ৩১ ডিসেম্বর ২০০০ সালে আলোকিত হয়ে জন্ম নেন শহীদ রফিকুল ইসলাম। বাবা মোহাম্মদ মমিন এবং মা সফিয়া বেগমের ঘরে আগমনের পর, রফিকুল হয়ে উঠলেন তাদের আশার প্রদীপ। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, রফিকুলের জীবন থেকে মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বাবার স্নেহময় ছায়া হারিয়ে যায়। এতিম রফিকুল তখন মায়ের আশ্রয়ে থেকে লড়াই করে বেড়ে উঠতে থাকে, অভাব-অনটন আর প্রতিকূলতার মাঝেই তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। মায়ের সীমিত সামর্থ্যেও রফিকুল থেমে থাকেনি। স্থানীয় থোল্লাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন তোল্লাকান্দি কেজি স্কুলে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর, সংসারের ভার বহন করতে বাধ্য হয়ে তিনি কাজের সন্ধানে পাড়ি জমান ঢাকা শহরে। নিজের স্বপ্নগুলোকে একটু একটু করে বিসর্জন দিয়ে পরিবারের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে থাকেন তিনি। ঢাকায় একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করে জীবনের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছিলেন রফিকুল। মায়ের কষ্ট লাঘব আর দুই ভাই-বোনের জন্য অল্প অল্প করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে, তিনি তার তরুণ জীবনকে নিয়োজিত করেছিলেন পরিবার ও দায়িত্বের প্রতি। কিন্তু এ সংগ্রামের মাঝেই জীবন যুদ্ধে হেরে গেলেন তিনি এক তরুণ শহীদ, যিনি কখনোই নিজেকে বড় কিছু ভাবেননি, কিন্তু যিনি নিজের ছোট্ট জীবন দিয়ে আমাদের বড় এক শিক্ষা দিয়ে গেছেন। রফিকুলের পরিবারের পরিস্থিতি আজও সেই কষ্টেরই সাক্ষী হয়ে আছে। তার একমাত্র বড় ভাই পঙ্গুপ্রায় অবস্থায় বাড়িতে রয়েছেন, আর তার বোন ও মা সেই একই কষ্টের সংসারেই কাটাচ্ছেন প্রতিটি দিন। শহীদ রফিকুল ইসলাম—যার জীবন ছিল সাধারণ, কিন্তু তার আত্মত্যাগ ছিল অসাধারণ। এ জীবনসংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের জন্য রেখে গেছেন অমূল্য প্রেরণা। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ রফিকুল ইসলামের শাহাদাতের পর তার পরিবারের ওপর যেন নেমে এসেছে এক গভীর অচলাবস্থা। এই পরিবার, যা একসময় সীমিত সামর্থ্যের মাঝেও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, আজ ভেঙে পড়েছে দুর্ভাগ্যের চরম ভারে। রফিকুলের বড় ভাই শফিকুল ইসলাম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পিকআপ ভ্যান চালিয়ে তিনি কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছিলেন, কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনা যেন তার জীবনকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিল। দুই পায়ে মারাত্মক আঘাতের কারণে তার পায়ের হাড়গুলো ভেঙে গিয়েছে, ডাক্তারদের মতে তার পায়ে পাঁচটি করে রিং বসানো হয়েছে। একসময়ের কর্মক্ষম শফিকুল আজ পঙ্গুত্বের শিকার। আর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও এখন একেবারেই ক্ষীণ। তিনি প্রতিটি দিন কাটাচ্ছেন গভীর উৎকণ্ঠায় মা, বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে কীভাবে চলবেন, কে এখন ধরবে এই ভেঙে পড়া পরিবারের হাল? অন্যদিকে, মা সফিয়া বেগম যেন পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছেন। ছোট ছেলে রফিকুলের অকালে চলে যাওয়ার শোকে তিনি প্রতিনিয়ত কাঁদেন। তিনি বারবার ফুঁপিয়ে বলেন, "আমার ছোট মানিকের কি দোষ ছিল? কেন ওকে মারলো? কে এখন আমাকে খাওয়াবে? কে দেখবে আমাদের?" তার এই প্রশ্নগুলো যেন আকাশে হারিয়ে যায়, কোনো উত্তর নেই। তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু বুকের ভেতর শোকের জ্বালাটি নিভে না। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দিন কাটছে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে। এই পরিবারে এখন নেমে এসেছে এক গভীর করুণার চিত্র। শারীরিকভাবে অসুস্থ শফিকুল, পাগলপ্রায় মা, আর দুঃখভারাক্রান্ত পরিবারের অন্য সদস্যরা যেন দিন গুনছে জীবনের যন্ত্রণাময় প্রহরগুলো। শহীদ রফিকুলের শাহাদাত শুধু তার জীবনের নয়, তার পরিবারেরও এক কঠিন বাস্তবতার সূচনা করে গেছে। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি শহীদ রফিকুল ইসলাম ছিলেন এক সাহসী তরুণ, যার বুকের ভেতর দেশপ্রেমের আগুন সর্বদা প্রজ্বলিত ছিল। প্রতিদিন আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে দাঁড়িয়ে তিনি সহযোদ্ধাদের সাথে ন্যায়ের পতাকা তুলে ধরতেন। তার সাহসিকতা, অগণিত প্রতিবাদী কণ্ঠের মাঝে এক দৃঢ় উচ্চারণ হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিকভাবে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, যার মর্মে ছিল দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু রফিকুল ছিলেন শুধু একজন সংগ্রামী নয়, তিনি ছিলেন এক দায়িত্বশীল পরিবারের কান্ডারি। ভাই শফিকুল ইসলামের অসুস্থতার পর তিনি কোনো দ্বিধা না করে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। নিজে ঢাকায় কাজ করে পরিবারকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন, যেন সংসারের ঘানি টেনে মায়ের কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিবারের ভালো থাকার প্রতি নিবেদিত। একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব এই ভারসাম্যের মাঝেও তিনি কখনো বিরতি নেননি। এলাকাবাসীর কাছে তিনি ছিলেন এক সহজ-সরল, সদালাপী তরুণ। প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম বেদনায় বলেন, "শহীদ রফিকুল ইসলাম ছিলেন অত্যন্ত সহজ-মনের একজন তরুণ। পরিবারের প্রতি তার দায়িত্বশীলতা ছিল অসীম। ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত থাকাকালীন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।" রফিকুলের মৃত্যু যেন এক অন্ধকার ছায়া ফেলে দিয়েছে পুরো এলাকায়। তার মৃত্যুতে এলাকাবাসী শোকে মুহ্যমান, তাদের প্রিয় একজন সন্তান হারিয়ে তারা যেন নির্বাক। এ শোক শুধু পরিবারের নয়, বরং পুরো গ্রামের, যারা একজন সাহসী, দায়িত্ববান তরুণকে হারিয়েছে। শহীদ রফিকুল ইসলাম আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার সাহসিকতা, তার সংগ্রাম, তার আত্মত্যাগ আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে। শাহাদাতের বর্ণনা ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—এই কয়েকটি দিন যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। প্রতিটি দিন ছিল ভয়, আতঙ্ক, আর অনিশ্চয়তার। ২১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে দয়। এই আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল দেশের সাহসী ছাত্র-যুব সমাজ, আর শহীদ রফিকুল ইসলাম ছিলেন তাদেরই একজন অকুতোভয় যোদ্ধা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রফিকুল ছাত্রদের সাথে আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন। বিকাল ৪টার দিকে রফিকুল তার অসুস্থ বড় ভাই শফিকুল ইসলামের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে চিটাগাং রোডের কাছে বিকাশ থেকে টাকা তুলতে বের হন। সেই মুহূর্তে রাস্তায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। চারদিকে শুধু স্লোগান আর আতঙ্কের শব্দ। রফিকুল, সম্পূর্ণ নিরীহ অবস্থায়, ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অত্যাচারী স্বৈরাচার কখনও নীরব থাকে না। কিছু বুঝে উঠার আগেই পেছন থেকে পুলিশের ছোঁড়া গুলি এসে বিদ্ধ করে রফিকুলের শরীর। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যায়, আর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। প্রতিবাদী রফিকুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় পথচারীরা উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও, সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রফিকুল আর ফিরে আসেননি, কিন্তু তার রক্তের দাগ মুছে যায়নি চিটাগাং রোডের সেই ফুটপাত থেকে। রফিকুল ইসলাম সবসময় শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি কখনও বৈষম্য, দুর্নীতি, বা নির্যাতনের কাছে মাথা নত করেননি। শেখ হাসিনার শাসনামলে একের পর এক ঘটেছে দমন-নিপীড়নের ঘটনা। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ, বিরোধী দলকে নির্মমভাবে দমন করা, আর ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা—এসবই ছিল তার ক্ষমতাকে ধরে রাখার নির্মম কৌশল। রফিকুলও এর প্রতিবাদ করেছিলেন নির্ভীকভাবে। তিনি ছিলেন বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীক। তার প্রতিবাদ ছিল ন্যায়বিচারের জন্য, তার জীবন ছিল এক সাহসী যাত্রা। আজ তার প্রাণ হারানো আমাদের জন্য শোক, কিন্তু তার সাহসিকতা আমাদের চিরকাল প্রেরণা হয়ে থাকবে। প্রস্তাবনা সমূহ এই পরিবারে আয় করার মত কেউ নাই। পরিবারের জন্য এমন কিছু করে দেওয়া হোক যেখান থেকে প্রতিমাসে অন্তত ২০০০০ টাকা আসবে। ২ টা সিএনজি বা অটো কিনে দেওয়া যায় যেখান থেকে প্রতিদিন ভাড়া বাবাদ দৈনিক ১০০০ টাকা পাওয়া যাবে। আনুমানিক খরচ ১০ লাখ টাকা। এক নজরে শহীদ রফিকুল ইসলাম নাম : রফিকুল ইসলাম জন্ম তারিখ ও বয়স : ৩১ ডিসেম্বর ২০০০, ২৩ বছর পেশা : প্লাস্টিক কোম্পানীর কর্মচারী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: থোল্লাকান্দি, ইউনিয়ন: বড়িকান্দি, থানা/উপজেলা: নবীনগর, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিতা : মৃত মোহাম্মদ মমিন মাতা : সুফিয়া বেগম, বয়স ৫০, গৃহিনী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৪ জন ভাই বোনের সংখ্যা : ২ জন ১) শফিকুল ইসলাম-বয়স- ২৫, অসুস্থ, সম্পর্ক: ভাই ২) সোনিয়া আক্তার, বয়স- ২২, বেকার শাহাদাত বরণের স্থান : চিটাগাং রোড আক্রমণকারী : পুলিশ বাহিনী আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ২১ জুলাই ২০২৪, রবিবার, আনুমানিক বিকাল ৪ টা দাফন করা হয় : থোল্লাকান্দি, বড়িকান্দি, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক৪৮'২০.৬"ঘ ৯০ক্ক৫৪'২৮.৩"ঊ ভাইবোনের বিবরণ : একমাত্র বড় ভাই অসুস্থ এর একমাত্র ছোট বোন বাড়িতে আছেন

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: রফিকুল ইসলাম
Image of মো: রফিকুল ইসলাম

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: পারভেজ হোসেন

মো: মিজানুর রহমান

মো: হাসান (হাফেজ হাসান)

মো:  রিটন উদ্দীন

মাজহারুল ইসলাম

মো: সাজ্জাদ হোসাইন ( সাব্বির )

মো:  সিয়াম সরদার (জিহাদ)

নাঈমা সুলতানা

 মোহাম্মদ ওয়াসিম

মো: জিহাদ হাসান মাহিম

মো: কামরুল মিয়া

মো: ইয়াছিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo