জন্ম তারিখ: ১৭ জুন, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : আশুলিয়া থানার সামনে
আশুলিয়ায় মির্মমতার বলি শাহাদাত ,বরণের দিন সকালে,বাবার সাথে শহীদ সুজয় এর কথোপকথন: বাবা: তানজিল, আজকেতো দেশের অবস্থা ভালো হবে মনে হচ্ছেনা বাবা। আন্দোলনে না গেলে হয়না? তানজিল: আব্বু, ,তুমি আমাকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিওনা প্লিজ। আজ আমরা হেরে গেলে আমাদের প্রিয় দেশও হেরে যাবে। শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় এর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে । শহীদের পিতা শফিকুল ইসলাম একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মাতা তাহমিনা আক্তার গৃহিণী। ছেলের পড়ালেখার সুবিধার জন্য বাবা গাজীপুর থাকতেন। ওখানেই ব্যবসা করতেন তিনি। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন শহীদ সুজয়। ইসরাত জাহান এনি ও ইসমাত জাহান সৌরিন নামে তার দ্ইুজন ছোট বোন আছে। বোনদের কাছে একমাত্র ভাই হিসেবে খুবই প্রিয় ছিল সে। শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় ২০১৫ সালে নবীনগর মিরপুর পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। ২০১৮ সালে সফিপুর আইডিয়াল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করেন। একই স্কুল থেকে ২০২১ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে অধ্যয়ন করে এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৪৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সর্বশেষ তিনি বদরে আলম সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে অধ্যয়নরত ছিলেন। পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে তিনি ভবিষ্যতে একজন ব্যাংকার হয়ে পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। যেভাবে শহীদ হলেন সুজয় ০৫ আগস্ট ২০২৪ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহা বিজয়ের দিন। দীর্ঘ পনেরো বছর জাতির উপর চেপে বসা দেশের সবচেয়ে বড় অজগরের বিদায়ের দিন এটি। এই দিনটি দেশের মানুষের জন্য যেমন আনন্দের তেমন বেদনারও ছিল। স্বৈরাচার মরণ কামড় হিসেবে শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় এর মত শত শত মেধাবী কিশোর, তরুণদের হত্যা করে পালিয়ে যায় এই দিনে।সুজয় প্রতিদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতো। সে আনুষ্ঠানিকভাবে মা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয় এই দিন। বাবার কাছে এই দিনটি তেমন সুখকর মনে হয়নি তাই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে বারণ করে। বিদায়ের সময় ছেলের সাথে বাবার কথোপকথনটি ছিল নিম্নরূপ- বাবা : তানজিল, আজকেতো দেশের অবস্থা ভালো হবে মনে হচ্ছেনা বাবা। আন্দোলনে না গেলে হয়না? তানজিল : আব্বু, তুমি আমাকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিওনা প্লিজ। আজ আমরা হেরে গেলে আমাদের প্রিয় দেশও হেরে যাবে। ছেলেকে বিদায় দিয়ে বাবা-মা চিন্তা করতে থাকে কখন কি হয়ে যায় আজকে! দুপুরের পর খবর এলো স্বৈরাচারি হাসিনা পালিয়ে গেছে পদত্যাগ করে। বাবার মনে একটু হলেও প্রশান্তির বাতাস লাগে। যাক, আমার ছেলেরা জিতে গেছে আজকে। ছেলেরা জিতলেতো বাবারাই জিতে। খুশিতে বাবা ছেলেকে দুপুরের খাবার খাওয়ানোর জন্য ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বার বার ফোন দেওয়ার পরও যখন ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন বাবা তাকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়ে। বাইপাইল, গাজীপুরের অলিতে গলিতে হন্ন হয়ে খোঁজছে বাবা তার একমাত্র ছেলেকে। লোকমুখে শুনতে পেল আশপাশে পুলিশ সাধারণ জনতার উপর উপর্যুপুরি গুলি ছুঁড়ছে। বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে লাগলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত চলে আসলো। একমাত্র ছেলেকে খেঁজে পাওয়া গেলনা কোথাও। নিরুপায় হয়ে নিকটাত্নীয় এক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে ছেলের মোবাইল এর লোকেশন ট্র্যাক করে দেখলো আশুলিয়া থানার আশপাশে আছে। খুঁজতে খুঁজতে সকাল হয়ে গেল। কাক ডাকা ভোরে আশুলিয়া থানার সামনে গিয়ে দেখে হাজার হাজার জনতা একটি ভ্যান গাড়িকে ঘিরে রেখেছে। ভ্যান গাড়ির উপর অনেকগুলো লাশ স্তুপ করা আছে। পাশে গিয়ে আকাশ ভেঙে পড়লো মাথার উপর। তার একমাত্র ছেলেকে ভ্যান গাড়ির উপর মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করলো বাবা। অগ্নিদগ্ধ দেহ। ছোট বোন এনিও বাবার সাথে গিয়েছিল ভাইকে খোঁজতে। ভাইয়ের দগ্ধ চেহারা চিনতে কষ্ট হচ্ছে বোনের। নির্বাক জনতা, নির্বাক এলাকাবাসী, নির্বাক পরিবার। কি অপরাধ ছিল এই ১৯ বছর বয়সী মেধাবী কিশোরের? গুলি করে ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ, পোড়ানো হলো কেন তাকে? সেদিন কি ঘটেছিল আশুলিয়ায়? স্বৈরাচার হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকাররের পতনের পর থেকে বের হয়ে আসতে থাকে আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের বর্বরতার একেক ঘটনা। ফাঁস হতে থাকে অডিও, ভিডিও সহ বিভিন্ন প্রমাণ। এসব ঘটনা দেখলে ও শুনলে যে কারো গা শিউরিয়ে উঠবেই। তেমনই একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় হাসিনার পতনের প্রায় একমাস পর। ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি ভ্যান গাড়িতে কয়েকটি লাশ পড়ে আছে স্তুপ আকারে। দুইজন পুলিশ সদস্য আর একটি লাশ নিচ থেকে ছুড়ে মারলো ভ্যান গাড়ির উপরে। লাশটি ভ্যানের উপরে থাকা অন্যান্য লাশগুলোর উপরে গিয়ে পড়লো ধপ করে। এটি দেখার পর দেশ বিদেশের সকল মানুষের মনে দাগ কাটে। প্রশ্ন উঠতে থাকে ভিডিওটি কোন এলাকার, কারা করেছে এমন নির্মম কাজ? গণমাধ্যমগুলো এটি নিয়ে তদন্ত শুরু করলে বেরিয়ে আসে সত্য ঘটনা। ভিডিওটি আশুলিয়া থানার পাশের একটি গলির ভিডিও। ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার বিজয় উল্লাসে আতংকিত আশুলিয়া থানা পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয়সহ আরো অনেকেই। পরে পুলিশ লাশ গোপন করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ভ্যান গাড়িতে উঠায় লাশগুলো। যদিওবা জনতার উপস্থিতির কারণে লাশ গোপন করতে ব্যর্থ হয়। পরে লাশ এর চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য ভ্যান গাড়িতে আগুন দেয়। এটা নিয়ে দেশের প্রথম সারির সকল গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে ঐ সময়। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের নিউজ লিংক নিচে যুক্ত করা হলো- https://jamuna.tv/news/560317 https://youtu.be/sU4GWTlWR1o?si=Yy3pAgeULgBgjhJs https://www.news24bd.tv/details/181935 https://www.comillarkagoj.com/details.php?id=194110 https://youtu.be/IKVu68p3zUM?si=RhKUHNqW31i_5TBYআমি বাঁচলে বীর মরলে শহীদ শাহাদাতের পর তানজিল মাহমুদ এর সুজয় এর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস ব্যাপক আলোচনায় আসে। শাহাদাত বরণের আগের দিন ০৪ আগস্ট রাতে তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে এই পোস্ট করেন। তিনি লিখেন- আল্লাহু আকবার! এ যেন ঘোষণা দিয়েই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে গেলেন সুজয়। আর বাতিলদের সফলতা ব্যর্থতার হিসেব শিখিয়ে গেলেন হাতে কলমে। চিন্তা করুন এমন শহীদ এ পৃথিবীতে কতজন আছে? এই পোস্টের মন্তব্যের ঘরে সোহাগ রহমান নামে তারই এক সহপাঠী লিখেন, ‘তোর বন্ধু হইতে পেরেও আমরা গর্বিত। আল্লাহ তোকে জান্নাতবাসী করুক তৌহিদ তালুকদার নামে আরেকজন লিখেন’, ‘তোমাদের হাত ধরে আজকের এই স্বাধীনতা। সালাম হে বীর, আজ থেকে প্রভাতের সূর্য রোজ তোমায় কুর্নিশ করে জেগে উঠবে এই বাংলায়। যতদিন বাংলাদেশ রবে, ততদিন ইতিহাসের পাতায় তোমার নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের দোয়া তোমার সাথে আছে, তুমি জান্নাতী ভাই আমার। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’ তানজিল মাহমুদ সুজয় এর ফেসবুক আইডি লিংক- https://www.facebook.com/share/bMEXXfhq844Na66U/?mibextid=qi2Omg সত্যানুসন্ধিৎসু সুজয় শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় ছিলেন একজন সত্যানুসন্ধিৎসু তরুণ। তিনি নিজে নিজে সত্য অনুসন্ধান করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেন। প্রতিবেশী হাজী আবু হানিফ বলেন, ‘সুজয় ছিলো অত্যন্ত নম্র ভদ্র ছেলে। নিজে নিজে কুরআন হাদীস পড়ে আবার মানুষকে দাওয়াত দিতো। নামাজ-কালাম পড়েতো।’ বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে দেশকে খ্বু ভালোবাসতো। সবাইকে ভারতীয় পণ্য বয়কটের জন্য উদ্বুদ্ধ করতো নিভে গেলো আলোর প্রদীপ পরিবারে শোকের মাতম ইশরাত জাহান এনি এবং ইসমাত জাহান সৌরিন শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় এর আদরের দুই বোন। এনি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে আর সৌরিন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। বোনদের একমাত্র ভাই হিসেবে সুজয় ছিল দুজনরই প্রিয়। ভাইয়ের কাছে নানা আবদার করতো তারা। সুজয়ও তাদের আবদার মেটানোর চেষ্টা করতেন। এনি বলেন, ‘ভাইয়া ছিল আমারা বন্ধু ও ভাই দুটোই। আমি আমার সকল সুখ দুখ ভাইয়াকে শেয়ার করতাম। ভাইয়া সবসময় আমার পাশে থাকতো। ভাইয়ার সাথে আমি ঝগড়া দিতাম। এখন আমি কার সাথে ঝগড়া দিবো?’ মা বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে পরিবারের প্রায় সকল স্বপ্ন ছিল শহীদ সুজয়কে ঘিরে। এখন তাকে হারিয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়েছে পরিবার। বাবা তার ব্যবসা গুটিয়ে চলে এসেছে গ্রামে। পরিবারে সবার চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। এক নজরে শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয় নাম : তানজিল মাহমুদ সুজয় পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৭ জুন ২০০৫ (১৯ বছর) আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, আনুমানিক বিকাল ৪ টা শাহাদাত বরণের স্থান : আশুলিয়া থানার সামনে দাফন করা হয় : ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নবীনগর, বিটঘর, বায়তুল মামুর মসজিদ কবরস্থান কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক৪৯'৪১.৮"ঘ ৯১ক্ক০৩'০৩.৪"ঊ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বিটঘর, ইউনিয়ন: বিটঘর, থানা/উপজেলা: নবীনগর, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিতা : মো: শফিকুল ইসলাম (৫০), ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মাতা : তাহমিনা আক্তার (৪০), গৃহিনী ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : গ্রামে ভিটাজমিতে একটি পাকা বাড়ি আছে, বর্তমানে ব্যবসা বন্ধ ভাইবোনের বিবরণ : ভাই নেই। দুই বোনের মধ্যে প্রথমজন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অপরজন ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। শহীদ সুজয়কে নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিউজ লিংক: https://youtu.be/f-pzo0Arwao?si=hLKPA5OaLt1n3jXS https://www.jugantor.com/country-news/840110 https://dailybhorerdak.com/details.php?id=233957