জন্ম তারিখ: ১ ডিসেম্বর, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্র, চাকুরীজীবি (কমমেটিকস দোকান), শাহাদাতের স্থান: ইদগাহ সংলগ্ন,শাহ ফকির বাজার
বিজয়ের এই শুভ দিনে,স্বস্তি আসে মনে, মহাধুমধাম আলোকোজ্জ্বল, স্পন্দন প্রাণে প্রানে, বীর বাঙ্গালির বীরত্ব গাঁথা, স্মরণ করি আমজনতা, শহীদ ভাইয়ের রক্তে রাঙানো পেয়েছি স্বাধীনতা। রক্ত মাখা ত্যাগ তিতিক্ষা, কেমনে ভুলি আমি?পেয়েছি আমার স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জন্মভূমি। মো: সিরাজুল হক ভূঞা মোহাম্মদ ইসমামামুল হক জীবন সংগ্রামে হার না মানা এক যোদ্ধা। তিনি ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার আমীরাবাদ ইউনিয়নের দর্জিপাড়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো: নুরুল হক এবং মাতা সাহেদা বেগম। তিনি অতি দরিদ্র একটি পরিবার থেকে উঠে আসা একজন সংগ্রামী তরুন। অল্প বয়সে বাবা হারিয়ে দু:খিনী মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে ইসমামুল ছিলেন বাবা- মায়ের মধ্যবর্তী সন্তান,যিনি মায়ের পাশাপাশি বাকি দুই ভাইয়ের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অভাবের সংসারে বড় হওয়া ইসমামুল ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করতে শিখেছিলেন। এজন্য তিনি ঢাকায় এসে একটি কসমেটিকস এর দোকানে চাকরী নেন। নিজে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পরিবারের জন্য বেশি অর্থ পাঠানোর চেষ্টা করতেন। দরিদ্রতার কষ্ট, কঠোর পরিশ্রম আর পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা ইসমামুলকে একটি বাস্তবিক জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক করে তুলেছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ঢাকা থেকে তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। যেভাবে শহীদ হলেন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছিল জুলাই‘২৪ জুড়ে। ছাত্ররা মূলত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা এবংসেমিনারেরমাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরেছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলনটি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়, যেখানে নিরাপত্তা বাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কারণ স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের নায্য দাবী না মেনে চালাচ্ছিলো অত্যাচারের স্টীমরোলার। সারাদেশ জুড়ে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোঁড়া হচ্ছিলো ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে। ইসমামুল এসব দেখে চুপ করে বসে থাকেনি। সে ও শুরু থেকে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করত। সর্বোপরি, ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ছাত্র জনতা, সেদিন বিকেলেই ঘোষণা আসে "লং মার্চ টু ঢাকা" হবে পরের দিন। এরই জের ধরে ৫ আগস্ট দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়। সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য ৫ আগস্ট খুবই আনন্দের দিন একইসাথে এটা ইসমামুল পরিবারের জন্য একটি অভিশপ্ত দিন। এদিন দুপুরে স্বৈরাচারি শাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটেছিল তারপরই চারিদিকে আনন্দ মিছিল শুরু হয়েছিল। আর এই মিছিলে যাওয়ার মনোভাব পোষণ করেন তিনি। দোকানের মালিক বারবার নিষেধ করলেও সে তা শুনেনি স্বাধীনতার আনন্দ যে বাধভাঙা।এই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে মিছিলে যোগ দেন ইসমামুল। মিছিল যখন ঢাকার চানখারপুল আসে তখন বিকেল ৪:৩০ এর দিকে একদল পুলিশ ও অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার সে মিছিলে হামলা করে। হামলার গুলিতে অনেক মানুষ গুরুতর আহত হয়, তারই মধ্যে একজন হলেন ইসমামুল। সাধারণ জনতা ধরাধরি করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ৭ আগস্ট বিকেল ৪:১৫ দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমান ইশমাম। তারপর তাকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রাতে, ইসমামুলের বাড়িতে শুধু কান্নার শব্দ। সবাই শোকে মুহ্যমান, চোখের জল থামানোর কোনো চেষ্টা কেউ আর করছে না। পরের দিন দুপুরে, তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শত মানুষের চোখের জল নিয়ে দাফন সম্পন্ন হয় ইসমামুলের। তার মৃত্যুতে সারা এলাকায় এক গভীর শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ তিনি শুধু একজন যুবক ছিলেন না, ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ। শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুল হকের জীবনের কাহিনী যেন এক অশ্রুসিক্ত পরিহাস। জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়গুলোতে যখন একজন যুবক নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা ও পরিবারকে নিয়ে ভাববে, ঠিক তখনই তার জীবন প্রদীপ জ্বলার আগেই নিভে গেল। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এই দোয়াই আজ সকলের মুখে। পরিবারের অচলাবস্থা শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুলের পরিবারের অবস্থা ছিল “নুন আনতে পানতা ফুরানোর” মতো। শহীদ ইশমাম ছিল তার বিধবা মায়ের ভরণপোষণের একমাত্র অবলম্বন।মায়ের এবং পরিবারের খরচ বহনের জন্য ছোট বয়সেই সে ঢাকায় একটি কসমেটিকস এর দোকানে চাকুরী নেয়। সেখানে যা বেতন পেত তার থেকে খুবই সামান্য হাতখরচ রেখে বাকি পুরো টাকাটাই তার অসহায় মায়ের জন্য পাঠিয়ে দিত। কিন্তু একদিন, অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ইসমামুল শহীদ হয়ে যান। তাঁর মৃত্যু তার মায়ের ও পরিবারের জন্য এক ঘোরতর অমানিশা। এখন তারা চিন্তিত, কিভাবে চলবেন এবং কিভাবে সংসারের খরচ চালাবেন। ইসমামুলের অভাব তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এই দুরবস্থার মধ্যে, তারা আশা করে সমাজ সহায়তা করবে, যাতে তাদের জীবনে কিছুটা আলো ফিরিয়ে আনা যায়। দ্রুত একটা আর্থিক সহায়তা না পেলে অনাহারে থাকতে হবে ইসমামুলের পরিবারকে। শোকাহত এলাকাবাসী কর্মের কারণে পৃথিবীতে মানুষ অমর হয়। মানুষ চলে গেলেও থেকে যার তার কর্ম। তেমনি মৃত্যুর পরে ও শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুল হক অমর। এলাকাবাসীর মুখে মুখে আজ ও তার সম্পর্কে বন্দনা। তার এক প্রতিবেশী বলেন ইসমামুল ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতো। কারো সাথে কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলো না। তার চাচাতো ভাই বলেন-শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুল হক ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল এবং মেধাবী একজন তরুণ। পরিবারের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্ববান ছিলেন তিনি। আমরা তার হত্যার বিচার চাই। অন্য আরেক প্রতিবেশী বলেন- ইসমামুল ছিলেন মিশ্র প্রকৃতির মানুষ। তিনি মানুষের সুখ-দুঃখের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিতেন। মসজিদের সংগে ছিলো তার ভালো সম্পর্ক। সর্বোপরি মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা বুঝি এমনই হয়, মহাকাল তাদেরকে অমর করে রাখে। তেমনি শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুলের মতো মহৎ মানুষেরা পৃথিবীতে আসে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু ফেলে রেখে যায় দীর্ঘ পদচিহ্ন। এজন্য বলাই যায় তার মতো কীর্তিমানের মৃত্যু নাই। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে নিন। আমিন! শহীদ পরিবারকে সাহায্যের প্রস্তাবনা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মারা যাওয়ায় শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুল হক পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসটি বন্ধ হয়ে গেছে। তার জনম দুঃখিনী মা ও ভাইয়েরা অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে, যাদের বুক জুড়ে রয়েছে শুধু হাহাকার। ১. ইসমামুলের মা এবং ভাইদের থাকার জন্য একটি মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ২. তার বড় ভাইয়ের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করা। ৩. তার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা ব্যয় বহন করা। এক নজরে শহীদ মোহাম্মদ ইসমামুল হক নাম : মোহাম্মদ ইসমামুল হক পেশা : চাকুরীজীবি (কমমেটিকস দোকান) জন্ম তারিখ ও বয়স : ০১-১২-২০০৭, ১৭ বছর মৃত্যু : ০৭ আগস্ট ২০২৪ ইং, বৃহস্পতিবার, আনুমানিক বিকাল ৪.১৫ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাহাদাত বরণের স্থান : ইদগাহ সংলগ্ন,শাহ ফকির বাজার দাফন করা হয় : দর্জিপাড়া স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দর্জিপাড়া থানা/উপজেলা: লোহাগাড়া, জেলা: চট্টগ্রাম পিতা : মৃত. নুরুল হক মাতা : সাহেদা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : টিনের ঘর ভাইবোনের বিবরণ : মোট ২ জন বড় ভাই : মহিবুল হক (বয়স ২১, বেকার) ছোট ভাই : আবু বকর (বয়স ১৩, হিফয অধ্যয়নরত) সমাধি : দর্জিপাড়া, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম