জন্ম তারিখ: ৮ মে, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান: বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার
তানভীর ছিদ্দিকী ছিলেন এক সংগ্রামী ও স্বপ্নবাজ তরুণ। যিনি ৮ মে ২০০৪ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চরম অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি তার স্বপ্নের পথে অটুট থেকে লড়ে গিয়েছেন। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে তার কাঁধে ছিল দায়িত্বের ভার কিন্তু সেই ভার কখনোই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি বরং তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পরিবারের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অঙ্গীকার। তানভীরের স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়া। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক জায়গায় পৌঁছাতে, যেখানে তার পরিবারের প্রতিটি সদস্য সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। অর্থ কষ্ট তাকে কখনও তার স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা যেন তার সমস্ত স্বপ্নকে তছনছ করে দিলো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি রাজপথে নেমে এলেন, যেখানে তার সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তানভীরের সেই ত্যাগের বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন শহীদের মর্যাদা—এক বীরের সম্মান, যা তার জীবনের সকল সংগ্রাম ও স্বপ্নকে মহিমান্বিত করেছে। তানভীর ছিদ্দিকীর জীবন যেন স্বপ্ন, সংগ্রাম, আর ত্যাগের এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ তানভীর ছিদ্দিকী এবং তার পরিবার যেন চিরলাঞ্ছিত এক মজলুম পরিবারের প্রতিচ্ছবি, যাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল কষ্ট, অপমান আর সংগ্রামের গল্পে মোড়া। তানভীরের জীবন শুরু হয়েছিল সেই দারিদ্র আর শোষণের ঘূর্ণিপাকে। যখন মাত্র দুই বছরের শিশু, তখন স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধের শিকার হয়ে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই দিনের আগুন শুধু তাদের ঘরকেই জ্বালিয়ে দেয়নি, ছাই করে দিয়েছিল তাদের জীবনের স্বপ্ন, নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কিছু সমাজপতির হিংস্র রাজনীতির কারণে তাদের গোটা গোষ্ঠীকে গ্রামছাড়া হতে হয়েছিল। সেদিন থেকেই তারা হয়ে গেলো নিরাশ্রয়, ভিটেমাটি হারিয়ে নানাবাড়ির অস্থায়ী আশ্রয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হলো। সামাজিক বৈরিতা আর অবজ্ঞা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তানভীরের পিতা, যিনি সম্মান নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাধ্য হয়ে দিনমজুরির কাজ বেছে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের যেন শেষ ছিল না—এলাকার প্রভাবশালী সমাজপতিরা এমনভাবে তার জীবনকে আঘাত করেছিল যে, কেউ তাকে কাজেও নিতে চাইত না। এই তীব্র অবহেলা, শোষণ, আর দারিদ্রের মাঝে তানভীর নিজেকে পরিবারের একমাত্র ভরসা হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। শহরের এক মেসে থেকে নিজের শিক্ষাজীবন চালানোর পাশাপাশি, টিউশনি করে সামান্য আয় করতেন তানভীর। সেই আয়ের প্রতিটি পয়সা দিয়ে তিনি তার পরিবারের অন্ন যোগাতেন। ছোট ছোট কষ্টের বিনিময়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর, দুঃখের দিনগুলোর অবসান ঘটানোর। কিন্তু আজ, সেই স্বপ্নের প্রদীপটি নিভে গেছে। তানভীরের মৃত্যুতে পরিবারটি যেন আবারও অসহায় এক অন্ধকারে ডুবে গেছে। তাদের জীবনের একমাত্র আশার আলো, সেই বাতিঘর, যা তাদের ত্রাণের প্রতীক হয়েছিল, তা আর নেই। তানভীরের শূণ্যতা কেবল একটি জীবন হারানোর কষ্ট নয় বরং একটি পরিবারকে চিরতরে ভেঙে পড়ার গল্প, একটি পরিবারকে জীবনের অন্ধকারে নিমজ্জিত করার নির্মম বাস্তবতা। যেভাবে শহীদ হলেন তিনি শহীদ তানভীর ছিদ্দিকী ছিলেন চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সাহসী প্রতীক। আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে তার কন্ঠস্বর ছিলো অপ্রতিরোধ্য। খুন, গুম, দুর্নীতি আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শহীদ তানভীর ছিলো প্রতিবাদের অন্যতম জলন্ত প্রদীপ। ষোলশহর, মুরাদপুর, এবং বহদ্দারহাট এলাকায় তার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ছিল আন্দোলনের অগ্রভাগে। ১৮ জুলাই ২০২৪, একটি নির্ধারিত কর্মসূচি অনুষ্ঠিত করার জন্য ছাত্ররা বহদ্দারহাট থেকে নিউমার্কেটে স্থানান্তরিত হয়। সফলভাবে সেই কর্মসূচি শেষ করার পর, যখন ছাত্ররা বাসায় ফিরছিল, তখনই ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। বহদ্দারহাট এলাকায় আচমকা হামলা চালায় আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং শ্রমিকলীগের সন্ত্রাসী সদস্যরা। গুলির শব্দে এলাকার শান্তি ভেঙে পড়ে। তানভীর, একজন সাহসী এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ছাত্র নেতা, সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এক মূহুর্তের জন্যও তিনি পিছু হটেননি, তবে হঠাৎ একটি গুলি তার শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তানভীরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেখানেও তাদের ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। এই বর্বরোচিত হামলা প্রমাণ করে, যে ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ নেই বরং ভিন্নমতকে নির্মূল করার জন্য যে নৃশংসতা চলছে, তা আবারও সামনে চলে আসে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তানভীরের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালান কিন্তু সন্ধ্যা ৭ টায় তার মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর সংবাদ এলাকাবাসীকে স্তব্ধ করে দেয়। তানভীরের জীবন ও মৃত্যুর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের দমনে যে অসঙ্গতি ও বৈষম্য রয়েছে, তা ধ্বংসাত্মক শাসনের চিত্র তুলে ধরে। তানভীর ছিল ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ের এক প্রতীক। তার মৃত্যু আজীবন আমাদের মনে করিয়ে দেবে, যে সত্যের পথে অগ্রসর হতে হলে কঠোর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। শোকে কাতর এলাকাবাসী তানভীরের অকাল মৃত্যুর শোকে পুরো এলাকা স্তব্ধ। সাহসী ও সংগ্রামী এই তরুণ ছিলেন ছাত্রদের নেতা, ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন অবিচল। তার আত্মত্যাগ তাকে এলাকাবাসীর জন্য এক অনুপ্রেরণার প্রতীক করে তুলেছে। তার পরিবারের প্রতি সবার সহানুভূতি গভীরতর হয়েছে কারণ তার প্রস্থান তাদের জীবনে অপূর্ণতার নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর সংগ্রাম ও শাহাদাত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে হলে ত্যাগ স্বীকার অপরিহার্য। তার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ও আত্মত্যাগ আগামী প্রজন্মের জন্য এক অম্লান প্রেরণা হয়ে থাকবে। এক নজরে শহীদ তানভীর ছিদ্দীকী নাম : তানভীর ছিদ্দিকী জন্ম তারিখ ও বয়স : ০৮-০৫-২০০৪, ২০ বছর পেশা : ছাত্র, ঐঝঈ পরীক্ষার্থী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: নোয়পাড়া পাড়া, থানা/উপজেলা: মহেশখালী, জেলা: কক্সবাজার পিতা : বাদশা মিয়া (৫০), দীনমজুর মাতা : সানু বেগম (৪০), গৃহিণী মাসিক আয় ৬০০০/- দিনমজুর পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৪ জন ভাই-বোনদের সংখ্যা : ২ জন ১) ইসতাকুল ইসলাম, বয়স- ১৫, ছাত্র, ১০ম, সম্পর্ক- ভাই ২) মোহাম্মদ আদিব,বয়স-০৮, ছাত্র, ৩য়, সম্পর্ক- ভাই শাহাদাত বরণের স্থান : বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার, আনুমানিক সন্ধ্যা ৭ টা দাফন করা হয় : নোয়াপাড়া মহেশখালী, কক্সবাজার কবরের জিপিএস লোকেশন : ২২ক্ক৩৮‘৪৪.৩২,৮′′ঘ ৯১ক্ক৮৪৩৭৭৪৩"ঊ ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : কিছুই নাই প্রস্তাবনা বাবার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিলে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরে আসতে পারে।