Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম

নাম: মোহাম্মদ ওয়াসিম

জন্ম তারিখ: ৬ ডিসেম্বর, ২০০১

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৬ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : ছাত্র, চট্টগ্রাম কলেজ অনার্স ৩য় বর্ষ, (সমাজবিজ্ঞান বিভাগ), শাহাদাতের স্থান : চিটাগাং রোড

শহীদের জীবনী

২০০১ সালের এক শান্ত বিকেলে, গ্রামীণ সবুজের মাঝে জন্ম নিয়েছিল শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম। তার জন্ম হয়েছিল এমন এক দরিদ্র পরিবারে, যেখানে আর্থিক অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী কিন্তু সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে ছিল ভালোবাসা আর আন্তরিকতার অফুরন্ত ভাণ্ডার। গ্রামের কাঁচাপথ ঘেঁষে, সবুজ ছায়ায় ঘেরা পরিবেশে তার শৈশব কেটেছে। এই নিরিবিলি গ্রামটি তার মনে শৈশবের সরলতা, প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানুষের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করেছিল। দারিদ্রের সীমাবদ্ধতা তার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি বরং তাকে মজবুত করেছিল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে। তার পরিবারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও, মোহাম্মদ ওয়াসিমের মধ্যে সবসময় ছিল এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি। শিক্ষার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা এবং সমাজের জন্য কিছু করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাকে শৈশব থেকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম পরিবার ছিল এক নির্ভীক সংগ্রামী পরিবারের প্রতিচ্ছবি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করত। পিতা শফিউল আলম ও বড় ভাই বহু বছর ধরে প্রবাসে। কিন্তু ওয়াসিম কখনও সেই পথকে নিজের জন্য ভাবেনি। তার কাছে প্রবাস ছিল এক অবিরাম অনিশ্চয়তার প্রতীক। সে মনে করত, নিজের দেশের মাটিতে থেকেই সে নিজের ভবিষ্যৎ গড়বে। তার স্বপ্ন ছিল, পিতার মতো দূরে নয়, বরং পরিবারের পাশে থেকে, দেশের জন্য কাজ করে একদিন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবে। শফিউল আলমও ছেলের এই স্বপ্নে স্বপ্ন দেখতেন। প্রবাস জীবনের ক্লান্তি তাকে শিখিয়েছিল, পরিবারকে একসাথে রাখা কতটা প্রয়োজনীয়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সব ছেড়ে দেশে ফিরে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন, পরিবারের সঙ্গে কাটাবেন জীবনের বাকিটা সময়। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা যেন আগেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল। শহীদ ওয়াসিমের আকস্মিক মৃত্যু শফিউলের সেই পরিকল্পনাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ওয়াসিমের শাহাদাত যেন তার পরিবারের জীবনের সব আলোর উৎস কেড়ে নিল। পিতার স্বপ্ন, সন্তানকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার সেই আকাঙ্ক্ষা আর পূর্ণতা পেল না। প্রবাস জীবনের অভিশাপ যেন ওয়াসিমের রক্তে লেখা হয়ে গেল, আর তার পরিবার ডুবে গেল গভীর শূণ্যতায়। একদিকে ছেলের অকাল মৃত্যু, অন্যদিকে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের নির্যাতন এই দুইয়ের ভারে শফিউলের হৃদয় ভেঙে গেল। একটিমাত্র সন্তানের স্বপ্নের মৃত্যু যেন পুরো পরিবারের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অন্ধকারের অতলে ঠেলে দিল। শহীদ সম্পর্কে প্রতিবেশীর অনুভুতি শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল ও হৃদয়বান এক তরুণ। যার জীবনের প্রতিটি ধাপেই ফুটে উঠত তার নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ এবং মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা। পরিবারের প্রতি তার অসীম দায়িত্বশীলতা তাকে এক অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানে চট্টগ্রাম কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ওয়াসিম ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী, যিনি শুধু নিজের ভবিষ্যৎ নয়। বরং সমাজের মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। ওয়াসিমের অমায়িক ব্যবহার, মানুষের প্রতি সহযোগিতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল। তার পরোপকারী মনোভাব ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত চারদিকে ছড়িয়ে ছিল। এমন একজন মেধাবী তরুণকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে, যা আমাদের অন্তরকে রক্তাক্ত করেছে। আমরা এই নির্মম হত্যার বিচার চাই, যাতে ওয়াসিমের মত আর কোনো তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে না যায়, এবং তার ত্যাগের সঠিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। শাহাদাতের অমিয় সুধা যেভাবে পান করলেন শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ, ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে নিজের নাম খোদাই করে রেখে গেছেন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের ষোলশহর স্টেশনটি রূপ নিয়েছিল এক বিভীষিকাময় রণক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে নিয়ে ছাত্রদের নির্ধারিত কর্মসূচি দমাতে সেখানে আগেই অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছিলেন এক অকুতোভয় বীর ওয়াসিম। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র কিন্তু তার মনোবল ছিল অটল; তিনি জানতেন, এই আন্দোলন সফল করতেই হবে। মোহাম্মদ ওয়াসিমের চোখে ছিল এক অদম্য স্বপ্ন এক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার। হাসিনার স্বৈরাচারী আচরণ এবং সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিল তার প্রবল ক্ষোভ। তিনি প্রতিদিন রাজপথে নামতেন, স্লোগান তুলতেন, কিন্তু কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। ওয়াসিম জানতেন, স্বাধীন দেশের মানুষের অধিকার আর ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে হবে, যতই ঝুঁকি থাকুক। সেদিনও, ষোলশহর স্টেশনের রক্তাক্ত বুকে দাঁড়িয়ে, ওয়াসিম দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন যে, শত্রুরা যতই গুলি চালাক, তিনি এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়বেন না। বিকাল ৪:৩০ মিনিটে, যখন নিরস্ত্র ওয়াসিমকে ঘিরে চারদিকে গর্জে উঠল বন্দুকের আওয়াজ, তখনও তিনি পিছপা হননি। তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল শত্রুর গুলিতে। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি পড়ে যান। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আহত ওয়াসিমকে হাসপালে নিয়ে যাওয়াটা ছিলো রীতিমতো আরেকটা যুদ্ধের মতো। গুলির আওয়াজের ভয়াবহতা ও টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় যেনো পুরো এলাকা একটি মেঘযুক্ত কালো আকাশ। তখনো তিনি আশাবাদী ছিলেন বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও, চিকিৎসকরা না ফেরার দেশে চলে গেছেন বলে বার্তা দেন। মুহুর্তেই মেঘযুক্ত আকাশ রক্তে রঙিন আভাতে পরিণত হলো। তার এই শাহাদাতের মাধ্যমে আন্দোলনের চেতনা আরও তীব্র হয়, আর হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ওয়াসিমের সেই অকুতোভয় আত্মত্যাগ আজও আমাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক মেধাবী, সাহসী এবং অনড় যোদ্ধা, যার স্বপ্ন ছিল একটি সমতা, ন্যায়বিচার এবং শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। এলাকাবাসীর শোক শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিমের মৃত্যুতে পুরো এলাকা যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। তিনি ছিলেন এলাকার গর্ব, এক সাহসী সন্তান, যার সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের আলোয় আলোকিত হয়েছিল প্রতিটি হৃদয়। ছাত্র আন্দোলনে তার বীরত্ব ছিল সহযোদ্ধাদের কাছে এক অনুপ্রেরণার উৎস। তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ, তার প্রতিবাদের প্রতিটি সুর, যেন ন্যায়ের জয়গান ছিল। যার মনোবল আর দেশপ্রেম তাকে সবার প্রিয়পাত্র করে তুলেছিল। পরিবারের প্রতি তার ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ ছিল গভীর, কিন্তু সেই ভালোবাসার চেয়েও বড় ছিল তার দেশের প্রতি দায়িত্ব। তার অকালে চলে যাওয়া যেন এলাকাবাসীর হৃদয়ে গভীর শোকের কালো মেঘ নিয়ে এসেছে। এলাকা হারিয়েছে তার সবচেয়ে সাহসী সন্তানকে, যিনি জীবনের বিনিময়ে দেখিয়ে গেছেন, স্বাধীনতার পথ কতটা বন্ধুর, কতটা কণ্টকাকীর্ণ। তার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা যেন এক নবীন শপথের প্রতীক ন্যায়, স্বাধীনতা, এবং সঠিকের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। মোহাম্মদ ওয়াসিমের এই অমূল্য আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির ইতিহাসে বীরত্ব ও সাহসের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার মৃত্যু শুধু একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা দেশপ্রেম আর ন্যায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, তারা কখনোই হারিয়ে যান না। তারা চিরকাল বেঁচে থাকেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়, বেঁচে থাকেন ইতিহাসের পাতায়, একটি শিখা হয়ে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সাহস আর সংগ্রামের আলো জ্বালিয়ে রাখবে। এক নজরে শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম নাম : মোহাম্মদ ওয়াসিম জন্ম তারিখ ও বয়স : ০৬-১২-২০০১, ২২ বছর পেশা : ছাত্র প্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম কলেজ অনার্স ৩য় বর্ষ, (সমাজবিজ্ঞান বিভাগ) স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মেহেরনামা বাজার পাড়া; থানা/উপজেলা: পেকুয়া, জেলা: কক্সবাজার পিতা : শফিউল আলম, প্রবাসী: ৪৭ মাতা : জোসনা বেগম, গৃহীনি: ৪৫ পরিবারের সদস্য সংখ্যা: ০৬ ১. মর্জিনা আকতার,গৃহিণী,২৬, সম্পর্ক: বোন ২. আরশেদ আলী,প্রবাসী, বয়স: ২৪, সম্পর্ক: ভাই ৩. সাবিনা ইয়াসমিন, বয়স: ১৭, শিক্ষার্থী: মেহেরনামা উচ্চ বিদ্যালয়, সম্পর্ক: বোন শাহাদাত বরণের স্থান : ষোলশহর স্টেশন, চট্টগ্রাম আক্রমণকারী : সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ শাহাদাতের সময় : ১৬ জুলাই ২০২৪ ইং, মঙ্গলবার, বিকাল আনুমানিক ৩:৩০ টা দাফন করা হয় : মেহেরনামা, পেকুয়া, কক্সবাজার। কবরের জিপিএস লোকেশন : ২২ক্ক৩৮‘৪৫.৭৮৯"ঘ ৯১ক্ক৮৪৪‘২৩৯৩"ঊ প্রস্তাবনা ১. শাহাদাতের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া ২. পরিবারকে এককালীন আর্থিক সাহায্য প্রদান

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম
Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম
Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম
Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম
Image of  মোহাম্মদ ওয়াসিম

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

হামিদুর রহমান

নাঈমা সুলতানা

মো: বেলাল হোসেন

মো: আরাফাত হোসেন আকাশ

মো: ইমন গাজী

মো: ওয়াকিল আহমদ শিহাব

ছাইদুল ইসলাম

মো: আমিনুল ইসলাম সাব্বির

হাফেজ মাসুদুর রহমান

মো: সরোয়ার জাহান মাসুদ

আলমগীর হোসেন

আল আমিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo