জন্ম তারিখ: ১৯ এপ্রিল, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : ছাত্র, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শাহাদাতের স্থান : লক্ষ্মীপুর তিতাখাঁ মসজিদের সামনে
২০০২ সালের ১৯ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার চরমোহন এলাকায় ভোরের প্রথম আলোর মতো জন্ম নেন শহীদ ওসমান পাটওয়ারী। সেই দিনটি শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো গ্রামটির জন্য এক আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছিল। তার জন্ম ছিল যেন এক প্রতীক, যেখানে ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনাময় সূর্য উদিত হলো। ওসমানের বাবা মো: আব্দুর রহমান ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি তার পরিবারের জন্য ভালোবাসা আর দায়িত্বের প্রতীক ছিলেন। মা রেহেনা আক্তার ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষিকা, যিনি তার শিক্ষা দিয়ে সমাজের অনেক শিশুকে আলোকিত করেছেন। তাদের আদরের সন্তান ওসমানও সেই আলো থেকে বঞ্চিত হয়নি। শৈশব থেকেই তার মধ্যে মেধার ঝিলিক ছিল স্পষ্ট, যেন প্রতিটি বইয়ের পাতা ছিল তার বন্ধু, প্রতিটি অধ্যায় ছিল তার চিন্তার জগতে এক নতুন দিগন্ত। ওসমান বেড়ে উঠেছিল তার জন্মভূমি চরমোহনের গ্রামীণ পরিবেশে। সবুজের মাঝে তার শৈশব কাটলেও তার মন ছিল আকাশের দিকে, বড় স্বপ্নের দিকে। তামিরুল মিল্লাত মাদরাসা থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করে সে তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল। তার মা-বাবা, গ্রামের মানুষ সকলেই গর্বিত হয়েছিল তার সাফল্যে। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন সে তার মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছিল। ওসমান পাটওয়ারী ছিলেন তার পরিবার এবং সমাজের জন্য এক আশার আলো। পড়াশোনায় বরাবরই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, সেই মেধাবী তরুণ চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের ৪র্থ সেমিস্টারের ছাত্র ছিল। তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। এই স্বপ্ন ছিল শুধু তার নয়, তার পরিবার এবং পুরো সমাজেরও। তারা দেখেছিল, ওসমানের চোখে জ্বলজ্বল করা ভবিষ্যতের সেই স্বপ্ন, যা হয়তো একদিন বাস্তবে পরিণত হতো। কিন্তু সে স্বপ্ন আজ আর পূরণ হবে না। সেই উজ্জ্বল মেধাবী তরুণ, যে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তার দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবে বলে আশা করেছিল, তার জীবন থেমে গেল এক নির্মম হাতে। কিন্তু তার জন্ম এবং জীবন আজও আমাদের মনে জেগে আছে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে, যা নতুন প্রজন্মের স্বপ্নবাজদের পথ দেখিয়ে যাবে। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভুতি শহীদ ওসমান পাটওয়ারী ছিল আমার প্রাণের বন্ধু, যার সাহসী হৃদয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করত। সে ছিল আদর্শের এক দীপ্ত প্রতীক, যিনি সবসময় অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহসিকতার সাথে তার মতামত প্রকাশ করতেন। তার অন্তরে একটি মহান শহীদি তামান্না বাস করত, যা তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে গুণান্বিত করত। আল্লাহ তায়ালা তার সেই তামান্না কবুল করেছেন, এবং তার আত্মা এখন আমাদের মাঝে চিরকালীন এক অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে। ওসমানের মহান আদর্শ ও ত্যাগ আমাদের পথপ্রদর্শক, যা আমাদের ভুল পথে যেতে বাধা দেয়। আমি, আমজাদ হোসেন, এই মহান বন্ধুর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, যার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের অমূল্য রত্ন। যেভাবে শহীদ হলেন ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রবিবার, লক্ষ্মীপুরের তিতাখাঁ এলাকায় ঘটেছিল একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা, যেখানে শহীদ ওসমান পাটোয়ারী, একজন বীর ছাত্র, সংগ্রামের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচিতে তিনি অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন, বুকে ধারণ করে প্রতিবাদের আগুন এবং স্বপ্ন একটি স্বাধীন সমাজের। তাঁর চোখে ছিল এক স্বপ্ন—একটি সমতা ভিত্তিক সমাজ যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। কিন্তু সেইদিনের মঞ্চ ছিল রক্তাক্ত প্রতিরোধের সাক্ষী। আওয়ামী লীগের সকল সংগঠনের নেতাকর্মীরা, যাদের হাতে ছিল অস্ত্র, তীব্র উন্মাদনায় আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ শুরু করে। যুবলীগের সভাপতি সালাহ উদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে, সন্ত্রাসী বাহিনী নিধনের উদ্দেশ্যে শত্রুতাপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে থাকে। আন্দোলনকারীরা সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরের ওপর নেমে আসে বিপুল সংখ্যক গুলির বর্ষণ। এই প্রেক্ষাপটে, যখন চারপাশে চিৎকার আর কান্নার রোল ওঠে, তখনই ওসমানের বুকের ওপর এসে বিদ্ধ হয় একটি গুলি। মুহূর্তেই তার শরীর যেন এলোমেলো হয়ে যায়, আর তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। অসীম যন্ত্রণার মধ্যে, ওসমানকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, পথে মৃত্যুর অন্ধকারে প্রবাহিত হয় তার জীবন। চিকিৎসকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন, কিন্তু সে চলে যায় চিরতরে। তার মৃত্যু দেশের ছাত্র সমাজের জন্য একটি বিরাট শূণ্যতা সৃষ্টি করে, একটি তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী ১৬ বছরের শাসন, যা একের পর এক মৃত্যুর অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে দেশের যুব সমাজকে। খুন, গুম, ধর্ষণ এবং দুর্নীতি—এগুলো ছিল তার শাসনের চিত্র। বাকস্বাধীনতা ছিল শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন, যা আজও অধরা। মানুষের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে প্রতিনিয়ত ঘটছে নৃশংসতা। ওসমান পাটওয়ারী ছিল প্রতিবাদের প্রতীক, যার জীবন দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন—সংগ্রাম কখনো থেমে যাবে না। তিনি ছিলেন সেই সাহসী তরুণ, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা নিয়ে লড়ে গেছেন। তার মৃত্যু শুধুমাত্র একটি জীবনকে হারানো নয়, বরং একটি মহৎ আদর্শের মৃত্যু। আজও আমরা তার ত্যাগের স্মৃতিতে অনুপ্রাণিত। আমরা জানি, ওসমান যেমন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তেমনই তার শহীদ হওয়া আমাদের সামনে এক নতুন পথের সংকল্প তৈরি করেছে। সে প্রতীক হয়ে থাকবে আমাদের হৃদয়ে, যেন আমরা দৃঢ়তার সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি। তার বীরত্বের গল্প আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে, এবং আমরা তার পথ অনুসরণ করে একটি নতুন সোনালী দিনের অপেক্ষায় থাকব—যেখানে স্বাধীনতা, সুবিচার এবং মানবাধিকারের প্রতিফলন ঘটবে। শহীদ পরিবারের আর্থিক অবস্থা শহীদের বাবা একজন ব্যবসায়ী। পরিবারের আয় ইনকাম মোটামুটি ভালো। মা একজন শিক্ষিকা। তাদের একটি পাকা বাড়ি ও অল্প জায়গা জমি আছে। এক নজরে শহীদ মো: ওসমান পাটওয়ারী নাম : মো: ওসমান পাটওয়ারী জন্মস্থান : দক্ষিণ রায়পুর, ৩ নং চরমোহন, ইউনিয়ন, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৯ এপ্রিল ২০০২, ২২ বছর পেশা : ছাত্র, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পিতা : মো: আব্দুর রহমান, ব্যবসায়ী, ৪৬ বছর মাতা : রেহেনা আক্তার, শিক্ষিকা, ৪৩ বছর পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৪ ভাই বোনের বিবরণ : এক বোন। এক ভাই আছে। দুজনই পড়াশোনা করে : মো. ওমর ফারুক (২৬), শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, সম্পর্ক-ভাই : ওহি আক্তার (১৮), ছাত্রী, আলিম ২য় বর্ষ, সম্পর্ক-বোন শাহাদাত বরণের স্থান : লক্ষ্মীপুর তিতাখাঁ মসজিদের সামনে আক্রমণকারী : সালাহ উদ্দিন টিপু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৪ আগষ্ট ২০২৪, রবিবার দাফন করা হয় : নিজগ্রামে কবরের জিপিএস লোকেশন : যঃঃঢ়ং://সধঢ়ং.ধঢ়ঢ়.মড়ড়.মষ/নঝঠ২অ১গঠখঢপউ৮ঝযঃ৮