Image of ইউনুছ আলী শাওন

নাম: ইউনুছ আলী শাওন

জন্ম তারিখ: ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭

শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : দোকান কর্মী, শাহাদাতের স্থান : শনির আখড়া

শহীদের জীবনী

লক্ষ্মীপুর জেলার সবুজ-শ্যামল দক্ষিণ মাগুরী গ্রাম। এখানে প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় লুকিয়ে আছে সরলতা, আর সেই সরলতার আঁচলে বেড়ে উঠেছিলেন শহীদ ইউনুছ আলী শাওন। ২০০৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব যেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি—একদিকে গ্রাম্য জীবনের সরলতা, অন্যদিকে অভাব-অনটনের চাপ। শাওনের বাবা আবুল বাশার, একজন সৎ ও পরিশ্রমী কৃষক। প্রতিদিন মাঠের ফসলের সাথেই লড়ে যেতেন তিনি, যেন মাটির গন্ধেই জীবনের শক্তি খুঁজে পান। শহীদের মা, কুলসুমা বেগম, সংসারের প্রতিটি কোণায় মায়ার হাত রেখে আগলে রাখতেন সন্তানদের। গৃহিণীর মতোই নিঃশব্দে, ত্যাগে-সমর্পণে জীবনের প্রতিটি দিন কাটাতেন তিনি। এই পরিবারে জন্ম নেওয়া শাওন, ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন সংগ্রামের রূপরেখা। কিন্তু এই সংগ্রাম তাঁকে কখনো ভেঙে দেয়নি, বরং শক্তির উৎস হয়ে ধরা দিয়েছে। সবুজ গ্রামে ঘেরা তাঁর শৈশব, দারিদ্রের ঘেরাটোপে বাঁধা থাকলেও, মাটির মতোই গভীর আর শান্ত ছিল। কর্মজীবন: শহীদ ইউনুছ আলী শাওন, দারিদ্রের অন্ধকারে জন্ম নিয়ে যিনি কখনো দমে যাননি। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। ছোট্ট গ্রামে শৈশব কাটলেও, অর্থনৈতিক কষ্ট তাঁকে বইয়ের পাতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সংসারের দায়ভার কাঁধে নিয়ে, কিশোর বয়সেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তিনি। শাওনের হৃদয়ের গভীরে ছিল একটি স্বপ্ন—পরিবারের মুখে হাসি ফুটানোর। মা-বাবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় তিনি ছেড়ে আসেন তাঁর শৈশবের গ্রাম, পা রাখেন নিষ্ঠুর শহরের পাথুরে পথে। নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির তীব্র যান্ত্রিক শব্দের মধ্যে, শাওনের জীবন ঘনীভূত হয় শ্রম আর ত্যাগের রক্তে। অল্প বেতনের সামান্য অংশ দিয়ে নিজের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর পর, বাকি সবটুকু পাঠাতেন প্রিয় পরিবারে। প্রতিটি টাকা যেন মায়ের হাসির ফোয়ারা হয়ে ফোটে, বাবার কপালের চিন্তার ভাজ মুছে যায়—এমনটাই ছিল তাঁর একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু সেই স্বপ্নের শহর, যেটিতে সুখ খুঁজতে তিনি এসেছিলেন, তা তাঁকে এক নির্মম পরিহাসে মুছে দেয়। অচেনা নগরীর পাথরে পাথরে ঘুরে বেড়ানো শাওনের হৃদয় যখন ক্লান্ত, তখনই মৃত্যু তাঁকে করে নেয় আপন। শহরের কঠিন পথ, যেখান থেকে তিনি আশার আলো খুঁজতে চেয়েছিলেন, সেখানেই তিনি নিস্তব্ধ হয়ে যান চিরতরে। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি: শহীদ ইউনুছ আলী শাওন ছিলেন এক অমায়িক, সাহসী এবং নির্লোভ মানুষ। তাঁর চলাফেরা ছিল এমনই সুন্দর ও শুদ্ধ, যা প্রত্যেকের মন ছুঁয়ে যেত। দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ছিল স্পষ্ট প্রতিটি কথায় ও কাজে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজের কর্তব্য ও দায়িত্বের মধ্য দিয়ে দেশকে সেবা করাই প্রকৃত ভালোবাসা।মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, শাওনের চাচাতো ভাই, গভীর শোকের সুরে তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, "শাওন কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। তাঁর আচরণ ছিল সবার প্রতি অমায়িক এবং শ্রদ্ধাশীল।" প্রতিবেশীদের প্রতি শাওনের ব্যবহার ছিল অতুলনীয়, এবং তাঁর এ স্নেহশীলতা তাঁকে সবার প্রিয় করে তুলেছিল। শাওনের মতো সাহসী, সদালাপী এবং সৎ একজন মানুষকে হারিয়ে শুধু পরিবার নয়, পুরো সমাজ আজ শোকের সাগরে ভাসছে। তাঁর ভালোবাসা, সততা আর নিরহংকার জীবনযাপন সকলের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। যেভাবে ভাইকে হারালাম: ২০ জুলাই ২০২৪, শনিবার—বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তে লেখা এক বর্বরতম দিন। সেই দিনটি ছিল যেন মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়ানক অধ্যায়ের সূচনা, যেদিন আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার তাদের ক্ষমতার লাঠিকে আঘাত হানে ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামা ছাত্র-জনতার উপর। সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনের চিৎকার নিস্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা, যেন প্রতিবাদের কণ্ঠগুলোকে নীরব করে দেওয়ার নিষ্ঠুর প্রয়াস। ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় দুপুরের দিকে এক দৃপ্ত ভোরের অপেক্ষা করছিল। পথে পথে ভিড় জমে উঠছিল—ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের সাধারণ মানুষও নেমে এসেছিল রাজপথে। তাঁদের সকলের উদ্দেশ্য একটাই—বৈষম্য আর স্বৈরাচারের শৃঙ্খল ভেঙে গড়তে হবে একটি নতুন বাংলাদেশ। আর সেই সংগ্রামের মিছিলে দৃঢ় পদক্ষেপে যোগ দিয়েছিলেন ইউনুস আলী শাওন, এক সাহসী যুবক যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করেই প্রতিবাদের সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রূপ নেয় বিভীষিকায়। হাসিনা সরকারের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী, সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজি ও সেক্রেটারি আকতারের নেতৃত্বে শতশত গুন্ডাদের নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর চালায় সরাসরি গুলি। কোন নিয়ম-নীতি, মানবিকতার তুচ্ছতম ধারাও তারা মানেনি। বুলেটের পর বুলেট ছুটতে থাকে নিরীহ ছাত্র-জনতার দিকে। এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে যায়—আকাশে ছড়িয়ে পড়ে কান্না আর আতঙ্ক। জনতার মিছিল ভেঙে যায় রক্তের ধারায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য প্রাণ। ইউনুছ আলী শাওন ও সেই নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে বিদ্ধ হন। সহকর্মীরা দিশেহারা হয়ে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেও, স্থানীয় আওয়ামী নেতারা সেই মানবিক প্রয়াসেও বাধা দেয়। কিন্তু কোনো বাধা তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। জনতার দাবির কাতারে নেমে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর আত্মত্যাগ ছিল অদম্য। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও, সময়ের ঘূর্ণিতে জীবনকে টেনে রাখা যায়নি। ইউনুছ আলী শাউন শেষ মুহূর্তে চোখ বুজলেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় তখনো বলছিল স্বাধীনতার গান, অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার। তিনি হাসিমুখে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিলেন, পান করলেন শাহাদাতের অমিয় সুধা। তাঁর রক্তে লাল হলো বাংলাদেশের মাটি, সেই মাটি যার জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। কেমন আছেন শহীদের পরিবার: শহীদ ইউনুছ আলী শাওনকে হারিয়ে তাঁর পরিবার এখন শোকে ভেঙে পড়েছে, যেন গোটা সংসারটি শূন্যতায় ঢেকে গেছে। মায়ের বুক জুড়ে শুধুই কান্নার অনুরণন, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে উঠে আসে একটাই নাম-শাওন। কুলসুমা বেগম, তাঁর একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে যেন জীবনের সব রং হারিয়ে ফেলেছেন। প্রতিটি স্মৃতিতে ছেলেকে মনে করে চোখের জল বাঁধ মানে না। প্রতিটি দিন কাটে সন্তানহীন মায়ের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায়। অন্যদিকে, শাওনের বাবা আবুল বাসার, যিনি ছিলেন গ্রার্মের একজন সাধারণ মানুষ, আজ অসহায় বোধ করছেন। তাঁর হৃদয়ে একটাই প্রশ্ন জেগে ওঠে বারবার—কি অপরাধ ছিল তাঁর ছেলের? ছোট্ট একটি দোকানের কর্মী হয়ে, কী এমন অন্যায় করেছিল যে আওয়ামীলীগ সরকার তাঁকে সহ্য করতে পারল না? এই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা, কিন্তু শোকের ভার তাঁকে নতজানু করেছে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল ইউনুস আলী শাওন। ছোট বলে, পরিবারে সবার আদরের পাত্র ছিল সে। ভাই-বোনদের ভালোবাসা আর স্নেহে শাওন বড় হয়ে উঠলেও, তাঁর জীবনের প্রদীপটি অকালে নিভে গেছে। সেই আদরের ভাইটি আজ আর নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতিরা যেন ঘরের প্রতিটি কোণে বেঁচে আছে। পরিবারে আজ কেবলই শূণ্যতা আর স্মৃতির ভার। এক নজরে শহীদ ইউনুছ আলী শাওন নাম : ইউনুছ আলী শাওন, দোকান কর্মী জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৯-০৯-২০০৭, ১৬ বছর পেশা : দোকান কর্মী : গ্রাম: দক্ষিণ মাগুরী, ইউনিয়ন: ৯নং উত্তর জয়পুর, থানা-চন্দ্রগঞ্জ, জেলা-লক্ষ্মীপুর পিতা : আবুল বাসার, কৃষক মাতা : কুলসুম বেগম, গৃহিণী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৫ : ওমর ফারুক, বয়স-৩৬ চাকরি, হামদর্দ কারখানা, মেঘনা, কুমিল্লা, সম্পর্ক: ভাই : কামরুল হোসেন, বয়স- ৩২, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, সম্পর্ক- ভাই : শিউলি আক্তার, বয়স-৩৮, গৃহিণী, সম্পর্ক- ভাই আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪ সাল শাহাদাত বরণের স্থান : শনির আখড়া আক্রমণকারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী পুলিশবাহিনী দাফন করা হয় : নিজগ্রামে, দক্ষিণ মাগুরী, উত্তর জয়পুর, চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর কবরের জিপিএস লোকেশন : যঃঃঢ়ং://সধঢ়ং.ধঢ়ঢ়.মড়ড়.মষ/৯ঢছ৮ঐীঊৎচফফপঐৎইঠ৬ প্রস্তাবনা ১. বাসস্থান প্রয়োজন। বাবার জন্য ভালো কোন কর্মসংস্থান করা দরকার

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of ইউনুছ আলী শাওন
Image of ইউনুছ আলী শাওন
Image of ইউনুছ আলী শাওন
Image of ইউনুছ আলী শাওন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আল মামুন আমানত

ইকরাম হোসেন কাউসার

মো: ফারুক

মো: ইফাত হাসান খন্দকার

মো: ওয়াকিল আহমদ শিহাব

মো: আরিফ বেপারী

 সৈয়দ মুনতাসীর রহমান আলিফ

মো: ইমন গাজী

মো: শাহাদাত হোসেন শাওন

মো: ইমতিয়াজ হোসেন

মো:  সিয়াম সরদার (জিহাদ)

 মোহাম্মদ ওয়াসিম

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo