জন্ম তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : মহিপাল সার্কিট হাউজ রোড, ফেনী
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে ১৬ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ। বাবা নেছার আহাম্মদ এবং মা ফাতেমা আক্তার। ছোট দুটি বোন রয়েছে তার। তিনি পড়াশোনা করতেন ফেনী সরকারি কলেজে। তার স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা শেষে পরিবারের হাল ধরবেন, বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটাবেন। কিন্তু স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পালিত সন্ত্রাসীর বুলেট শ্রাবণের সে স্বপ্ন কেড়ে নিলো। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছাত্ররাই অজেয়- এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এ সফলতা যতটা না সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে চলাকালীন তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। এর ফলে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ছাত্র আন্দোলন 'সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ' এর মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহীত। এ শ্রেষ্ঠত্ব যুগে যুগে লুফে নেয় তরুণ ছাত্র-জনতা। একজন সচেতন ছাত্র দেশ ও জাতির সক্রিয় কার্যকর প্রতিবাদী জনশক্তি। এ তরুণ ছাত্র সমাজ যখন কোনো যৌক্তিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে তখনই তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ। পরিবারে অভাব অনটন মাথায় রেখে স্বপ্ন দেখা তরুণ প্রজন্মের আইডল শহীদ ইশতিয়াক পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তা কখনো কল্পনাতীত ছিল না। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয় । আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, জঅই সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। উত্তপ্ত রাজপথ ভোটচোর আওয়ামী সরকার তার গুম-খুন রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাইয়ের শুরুতে ছাত্রদের করা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে ঘুরানোর জন্য নানা রকম কুটচাল চালতে থাকে। তাদের কোনো চালে ধরা না দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দৃঢ়তা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে স্বৈরাচার সরকার। ১৬ জুলাই থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নৈরাজ্য; গুম, খুন ও হত্যা সহ নানা অপকর্ম। ১৭, ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালায় গণহত্যা! শহীদের মিছিলে যুক্ত হয় আবু সাঈদ আর মুগ্ধ'র মতো শত শত শিক্ষার্থীর নাম। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রদের খুনে হাত রাঙানো স্বৈরাচারী হাসিনা ইন্টারনেট বন্ধ করে সারাদেশে কারফিউ জারি করে। নিত্য প্রয়োজনীয় জরুরী কাজ ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হতে পারবে না। যেকোনো জায়গায় ১০/১২ জন একসাথে দেখলেই কোনো সতর্কতা ছাড়া চালানো হচ্ছে গুলি। তারপর একটার পর একটা দিন গেছে আর ফাল্গুনের গাছের শুকনো পাতার মতো দল বেধে ঝরে গেছে বাংলার সোনার সন্তানেরা। প্রতি দিন গণহত্যা! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে রাজপথে নামে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে খুনি সরকারের পৈশাচিকতা। কি নারী কি পুরুষ; কি যুবক কি শিশু; কোনো কিছুই বিবেচনা করে না খুনি হাসিনার গুন্ডাবাহিনীরা। যাকে যেভাবে পাচ্ছে তাকে সেভাবেই হত্যা করছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। নিজের সন্তানদের রক্ষায় রাজপথে নেমে এসেছে সবাই। এবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়ে গেছে এদেশের আপামর জনতার আন্দোলন; গণমানুষের আন্দোলন। সবাই মিলে একযোগে ডাক দিলো নতুন এক বিপ্লবের। সব দফা সব দাবি একত্রিত হয়ে নতুন স্লোগান হয়েছে 'এক দফা এক দাবি হাসিনা তুই কবে যাবি?' এবার প্রতিটি জেলায়, থানায়, গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে বিপ্লব। শ্রাবণের ফেনীতেও লেগেছে জুলাই বিপ্লবের আগুন। যে আন্দোলনে আবু সাঈদ, মুগ্ধ ভাইয়াদের মতো শত শত মেধাবী শিক্ষার্থীরা শহীদ হয়েছে সে আন্দোলনে শ্রাবণ যেতে চায়। মরবে না বাচবে সেই চিন্তা করার এখন সময় নাই। ঢাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে সাধারণ মানুষের উপর গুলি ছুঁড়ছে রক্তপিপাসু খুনি হাসিনা সরকার। একজন শিশু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে। স্বৈরাচার প্রশাসন কোথাও চার-পাঁচজন একত্রিত হতে দেখলেই গুলি করছে। রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন, সমিতি, সংস্থা, আলেম-ওলামা যে-ই সরকারের এই তাণ্ডবের প্রতিবাদ করছে তার উপরই নেমে আসছে গ্রেফতার, জেল-জুলুম, গুম, হত্যা আর নানাবিধ লাঞ্ছনা বঞ্চনা। গণগ্রেফতারে ভরে ফেলেছে সারা দেশের কারাগার। ৪ আগস্ট, সরকার পতনের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ডাকা অবৈধ সরকারের বিপক্ষে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারা দেশে ব্যাপক সংঘাত হয়। অবৈধ স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের নৈরাজ্য যেন একাত্তরের পাকবাহিনীর সন্ত্রাসকেও হার মানায়। মানুষ যেন দিনে দুপুরে প্রত্যক্ষ করছে ২৫ মার্চের কাল রাত! পরিস্থিতি এমন দেখে বিক্ষোভকারীরা সারাদেশে নাগরিকদের 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির আহবান জানায়। শুরুতে ৬ আগস্ট ' মার্চ টু ঢাকা ' কর্মসূচি জানানো হলেও পরে তা একদিন আগে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেওয়া হয়। আন্দোলনে যোগদান বাংলাদেশ নামক গাড়িটা যখন এমনভাবে ব্রেক ফেইল করলো আর বাংলাদেশী নামক যাত্রীরা যখন আতঙ্কিত; চারদিকে যখন কষ্ট, বেদনা, চিৎকার, আহাজারি আর নিশ্চিত ধ্বংসের সুস্পষ্ট লক্ষণ, তখন ইশতিয়াক আহমেদ মত সচেতন তরুণ, মেধাবী শিক্ষার্থী কি বসে থাকতে পারে? তার হৃদয়ে কি দাগ কাটতে পারেনা? রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন বর্বরতা দেখে সমাজ সচেতন একজন শ্রাবণের মনেও আঁচড় কাটতে পারে। কেননা সবকিছু তো তার সামনেই ঘটছে। তিনি নিজের কানেই শুনছেন মানুষের নিদারুণ আর্তনাদ; ব্যথিত মনের হাহাকার। নিজের চোখে দেখছেন কিভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে শাসক নামধারী শোষক গোষ্ঠী। ৪ আগস্ট ২০২৪ মহীপাল সার্কিট হাউস রোডে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইশতিয়াক ইশতিয়াক আহমেদ। যেভাবে শহীদ হলেন ৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার। মহীপাল সার্কিট হাউস রোডে আন্দোলন রত মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইশতিয়াক ইশতিয়াক আহমেদ। আন্দোলনরত মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে থামতে অকস্মাৎ নির্বিচারে আক্রমণ করে বসে রক্তপিপাসু স্বৈরাচারী হাসিনার পালিত ঘাতকের দল। মিছিলের উপর আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা উপর্যুপরি গুলি বর্ষণ শুরু করে; মুহুর্তেই হায়েনার মত হিংস্র হয়ে উঠে মরণ কামড় দেয় । বালিগাও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু ও স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা কালামোহনসহ আরও অনেক লোক উপর্যুপরি গুলি ছুঁড়ছিলেন। হঠাত কয়েকটি গুলি এসে লাগে ইশতিয়াক আহমেদের মাথায় ও পিঠে। মাথায় গুলি লাগার সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন; আর শহদি কাফেলায় নিজের নাম যুক্ত করেন ইশতিয়াক আহমেদ। আওয়ামি কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের নৃশংস বর্বতার স্বীকার হয়ে অকালে ঝরে গেলো আরও একটি তাজা প্রাণ। জানাজা ও দাফন পরবর্তীতে নিজ এলাকায় শহীদের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে শহীদ ইশতিয়াক আহমেদকে এলাকার কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। কেমন আছে শহীদের পরিবার শহীদ ইশতিয়াক আহমেদের বাবা নেছার আহমদই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি। তিনি একটি ব্রিক ফিল্ডে মাত্র ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। যা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাদের পরিবার খুবই অসচ্ছল। প্রিয়জনদের ভাষায় শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শহীদ ইশতিয়াকের মামা বলেন- শ্রাবণ খুবই বিনয়ী ছিলেন। নামাজ পড়তো নিয়মিত, সত্যবাদি ছেলে। তার জানাজায় ফেনীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয়। ইশতিয়াকের বন্ধু বলেন- সে খুবই ভালো মনের ছেলে, খেলা-ধুলা পছন্দ করত। তার বন্ধুদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। যেদিন শহীদ হয় সেদিন মায়ের থেকে দোয়া হিসেবে মায়ের ওড়না নিয়ে বের হয়। একনজরে শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ নাম : ইশতিয়াক আহমেদ পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৬/১২/২০০৪, ২০ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, আনুমানিক দুপুর ১:৪৫ টা শাহাদাত বরণের স্থান : মহিপাল সার্কিট হাউজ রোড, ফেনী দাফন করা হয় : দক্ষিণ আনন্দপুর, ফুলগাজী, ফেনী কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক০৪'৪৯.১"ঘ ৯১ক্ক২৫'৫৫.৬"ঊ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ আনন্দপুর, থানা/উপজেলা: সোনাগাজী, জেলা: ফেনী পিতা : নেছার আহাম্মদ মাতা : ফাতেমা আক্তার ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : অসচ্ছল পরিবার। ভাইবোনের বিবরণ : ছোট দুই বোন রয়েছে। প্রস্তাবনা ১. বাবার জন্য কোন ব্যবসার ব্যাবস্থা করে দিলে ভালো হয় (বাবা ডিগ্রি পাশ) ২. ছোট বোনদের লেখাপড়ার খরচ যোগানে সহযোগিতা করা যেতে পারে ৩. শহীদের পরিবারকে নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান করা