জন্ম তারিখ: ২৩ নভেম্বর, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান: মহিপাল, ফেনী
যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিও গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। বাবা মায়ের মুখ আলোকিত করে ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর ফেনী জেলার দাগনভূঞা উত্তর জায়লস্কর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন একটি নবজাতক। প্রথম সন্তান এবং পুত্র হওয়াই প্রবাসী বাবা খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাম রাখেন সরোয়ার জাহান মাসুদ। বাবা মো: শাহ জাহান টিপু দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত এবং মমতাময়ী মা বিবি কুলসুম জাহান গভীর যত্নে লালন পালন করেন তার তিন সন্তানকে। তারা সকলে পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। বাবার প্রবাস থেকে পাঠানো টাকায় খুশিতে চলছিল তাদের দিনগুলি। বড় ছেলে মাসুদ ফেনী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। সে খুবই ভদ্র এবং পরোপকারী ছেলে। গ্রামের সবার বিপদে আপদে আগে ছুটে যেতন তিনি। তাছাড়া মাসুদ ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নিয়মিত নামাজ পড়তেন। যেভাবে শহীদ হলেন জুলাই‘২৪ জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশ ছিল উত্তাল। আর এই আন্দোলনে শুরু থেকেই সরোয়ার জাহান মাসুদ সরব ছিলেন। তিনি মুখ বুঝে বসে না থেকে আন্দোলনের শুরু থেকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তিনি ভাবতেন, সরকার যেন এই কোটা সংস্কারের মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার পথ সুগম করেন। তার ও ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে বড় সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার, যাতে তিনি দেশের মানুষের সেবা করতে পারেন। পরবর্তীতে এই আন্দোলন যখন সরকার পতনের দিকে ধাবিত হলো তখন মাসুদ আরো সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলেন দেশের মানুষকে স্বৈরাচারী সরকার থেকে বাঁচাতে।এরই পথ ধরে আন্দোলনে অংশ নিতে ৪ঠা আগস্ট ২০২৪ সকাল ১০টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইক নিয়ে মহিপালে যান। সাড়ে ১২টার দিকে উত্তাল জনতার সাথে মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে ছিলেন বাইক নিয়ে। হঠাৎ করে দুপুর ১টা ৪৫ এর দিকে আন্দোলনরত ছাত্রজনতা, যারা স্টার লাইন বাস কাউন্টারের দিকে অবস্থান নিয়েছিল, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ঐদিকে গোলাগুলি শুরু করে। মাসুদ তখন বাইক নিয়ে সে জায়গা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে ১ টা ৫০ এর দিকে ফেরার পথে সার্কিট হাউস রোডে সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে পড়ে যান মাসুদ। একটি ঘাতক বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার বুকে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন মাসুদ। আশপাশের কিছু জনতা যখন আহত অবস্থায় মাসুদকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো, পথিমধ্যে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। শহীদ হলেন সরোয়ার জাহান মাসুদ,ঝরে গেলো আরো একটি তাজা প্রাণ। খালি হলো আরো একটি মাতাপিতার কোল। সর্বোপরি, ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ছাত্র জনতা, সেদিন বিকেলেই ঘোষণা আসে "লং মার্চ টু ঢাকা" হবে পরের দিন। তারই জের ধরে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরই মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়। কিন্তু সেই মুক্ত দেশের মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি শহীদ সরোয়ার জাহান মাসুদ। তারই জন্য কবি হয়তো লিখেছিল- "উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রান যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।" কেমন আছে শহীদ মাসুদের পরিবার পরিবারের বড় সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় মাসুদের মমতাময়ী মা এবং তার বাবা। কেননা প্রথম বাবা-মা ডাক যে তার কাছে থেকে শোনা। শোকে কাতর তার ছোট ভাই দুটো। বাড়ির সমস্ত আঙ্গিনা জুড়ে তারা মাসুদের স্মৃতি দেখতে পায়। বাবা প্রবাসে থাকেন বলে আর্থিক অবস্থা ভালো মাসুদের পরিবারে।কিন্তু মাসুদের শোকে তারা দিশেহারা। পাড়াপড়শিরা তাদের বিপদে পাশে থাকার বন্ধুকে হারিয়ে শোকে কাতর।জীবন শুরু হওয়ার আগেই হারিয়ে গেলো সম্ভাবনাময় একটি নিষ্পাপ প্রাণ। এজন্যই ইংরেজ কবি হয়তো লিখেছিলেন “গধহু ধ ৎড়ংব রং নড়ৎহ ঃড় নষঁংয ঁহংববহ” প্রতিবেশি ও স্বজনদের অনুভুতি কর্মের কারণে পৃথিবীতে মানুষ অমর হয়। মানুষ চলে গেলে ও থেকে যার তার কর্ম। তেমনি মৃত্যুর পরে ও শহীদ সরোয়ার জাহান মাসুদ অমর। এলাকাবাসীর মুখে মুখে আজ ও তার সম্পর্কে বন্দনা। শহিদ মাসুদ সম্পর্কে তার এক প্রতিবেশী শেখ নেয়াজ বলেন- “খুব মানবিক,ভদ্র ও নম্র ছিলো সে। পরিবারে বড় সন্তান হিসেবে অনেক দায়িত্বশীল ছিল সে। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করতো সে।” তার ফুফাতো ভাই বলেন- “মাসুদ নামাজী ছিলেন এবং সে অত্যন্ত নম্র ভদ্র একটা ছেলে ছিলেন।” মাসুদ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চাচাতো ভাই আরও বলেন-“তার ভেতরে প্রবল মনুষত্ব ছিলো। সে অন্যের বিপদকে নিজের মনে করে সবার আগে ছুটে যেতো।” সর্বোপরি মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা বুঝি এমনই হয়, মহাকাল তাদেরকে অমর করে রাখে। তেমনি শহীদ সরোয়ার জাহান মাসুদের মতো মহৎ মানুষেরা পৃথিবীতে আসে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু ফেলে রেখে যায় দীর্ঘ পদচিহ্ন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাঁর এই অবদান জাতি আজীবন মনে রাখবেন। মহান আল্লাহ তাঁর শাহাদাতকে কবুল করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুক (আমিন)। এক নজরে শহীদ মো: সরোয়ার জাহান মাসুদ নাম : মো: সরোয়ার জাহান মাসুদ পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ২৩/১১/২০০৩, ২১ বছর প্রায়। আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, আনুমানিক দুপুর ২: ০৫ টা শাহাদাত বরণের স্থান : মহিপাল, ফেনী দাফন করা হয় : মহিপাল, ফেনী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: উত্তর জায়লস্কর, থানা/উপজেলা: দাগনভূঁইয়া, জেলা: ফেনী পিতা : শাহজাহান টিপু মাতা : বিবি কুলসুম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : ৩ তলা পাকা বাড়ি; সচ্ছল পরিবার ভাইবোনের বিবরণ : ছোট দুই ভাই রয়েছে। মেজো ভাই : মাসুম আল সামির (বয়স-১৯, একাদশ) ছোট ভাই : সায়েম সুলতান (বয়স-১২,হিফজ) সমাধি : মহিপাল, ফেনী