জন্ম তারিখ: ২১ মে, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা: ড্রাইভার, শাহাদাতের স্থান : মহিপাল, ফেনী
“অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক” শহীদ জাকির হোসেন শাকিব, সময়ের এক অমূল্য সম্পদ, একজন সাহসী তরুণ, যিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রজ্জ্বলিত মশাল হয়ে উঠেছিলেন। ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার মান্দানা গ্রামে ২১ মে ২০০৫ সালে জন্মগ্রহণ করা শাকিব ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সংগ্রামী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক। তাঁর পিতা আব্দুল লতিফ প্রবাসী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং মা কহিনুর আক্তার ছিলেন ঘরের কর্তা, যিনি সন্তানদের বড় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। শাকিবের দুই ছোট ভাই রয়েছে—জাহিদুল হাসান, একজন টেইলর এবং জুনায়েদ ইসলাম, মাত্র ছয় বছর বয়সী এক শিশু। পরিবারটি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হলেও, শাকিবের মধ্যে ছিল সীমাহীন ইচ্ছাশক্তি এবং দেশের জন্য কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। শাকিবও এই আন্দোলনের নেতৃত্বে অংশ নেন, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। ৪ আগস্ট ২০২৪, ফেনী শহরের মহিপাল এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে শাকিব নির্মমভাবে নিহত হন। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা জিয়া উদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বে সশস্ত্র হামলায় শাকিবের মাথায় গুলি লাগে এবং তিনি সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। সেদিনের সেই পিচঢালা রাজপথ সাকিবের রক্তে রঞ্জিত হয়। শাকিব মারা গেয়েছেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য এক নতুন উদ্দীপনা এবং লড়াইয়ের সাহসের উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর রক্তের বিনিময়ে তিনি আমাদের দিয়েছেন অজেয় হিম্মত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা। তাঁর কবর ফেনীর মহিপালে, যেখানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। শহীদ শাকিব আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন, একজন সংগ্রামী যোদ্ধা হিসেবে যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ঘটনা সংক্রান্ত বিবরণ গত ৪ আগস্ট ২০২৪, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ফেনীর মহিপাল যেন রক্তাক্ত অধ্যায় হয়ে উঠেছিল । একদল নিরস্ত্র, নিপীড়িত শিক্ষার্থী তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপাল এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নেয়। বুকে ছিলো সাহস, হাতে ছিলো মাত্র কিছু প্ল্যাকার্ড আর কণ্ঠে ছিলো ন্যায়ের দাবির স্লোগান। তাঁরা লড়ছিলেন এক অসম যুদ্ধে, যেখানে তাদের একমাত্র অস্ত্র ছিলো সত্য আর ন্যায্যতা। বেলা ২টা বাজতে না বাজতেই পুরো ফেনীর আকাশ ভারী হয়ে ওঠে বোমা ও গুলির গর্জনে আর জমিন থমথমে হয় আওয়ামী জালিমদের হিংস্রতায়। শহরের ট্রাংক রোড থেকে আওয়ামী লীগের একদল সশস্ত্র নেতাকর্মী এগিয়ে আসে মহিপাল ফ্লাইওভারের দিকে, যেখানে অপেক্ষায় ছিলো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে শাকিবও ছিল—এক তরুণ, যার স্বপ্ন ছিলো এই দেশটাকে বৈষম্যহীন ও ন্যায্যতার মাটিতে দাঁড় করানো। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথেই মৃত্যুর অন্ধকার নিয়ে আসে সেদিনের সন্ত্রাসী হামলা। আওয়ামীলীগের সশস্ত্র কর্মীরা আচমকাই মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে থাকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দিকে। প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। একের পর এক গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, আর আকাশে কালো ধোঁয়া; সেদিনের বিকেল যেন এক অভিশপ্ত স্মৃতির জন্ম দেয়। নিরুপায় শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার জন্য ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাদের সেই প্রতিরোধ ছিল অত্যন্ত দুর্বল, কারণ তাঁদের হাতে অস্ত্র ছিল না, ছিল কেবল সাহস। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে থাকা সংঘর্ষে চারিদিকে রক্তাক্ত দেহ ছড়িয়ে পড়ে। শাকিবসহ অন্তত ৯ জন শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও পথচারী নিহত হয়। যাদের জীবন অকালে নিভে যায় এই নির্মম আক্রমণে। তাঁদের স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যায় রক্তের ধারা, আর আন্দোলনকারীদের বুকেও রয়ে গেল গভীর ক্ষত আর স্বজনের বুকে শোক। সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ আর প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি একটাই—এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যারা সশস্ত্র হয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়, নির্মমভাবে তাদের জীবন ছিনিয়ে নেয়। শাকিবদের স্বপ্ন মুছে গেলেও, তাঁদের রক্তে মাখানো পথ একদিন বয়ে নিয়ে আসবে ন্যায়ের দাবি, এমন আশায় বুক বাঁধে বেঁচে থাকা সহযোদ্ধারা। এ ছিল এক ভয়াবহ দিন, যেখান থেকে উঠে আসবে এক নতুন ইতিহাস—বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক লড়াই, যেখানে ন্যায়ের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল তরুণ শাকিবসহ অনেককে। অথচ তাদের দাবি ছিল সামান্য—একটি বৈষম্যহীন সমাজ। কিন্তু সেদিন সেই স্বপ্নের সঙ্গে নিভে যায় শাকিবের জীবন, রেখে যায় অবিরাম প্রশ্ন ও গভীর শোক। কেমন আছেন শহীদ পরিবার শহীদ জাকির হোসেন (শাকিব) এর পরিবার আজ শোক ও অসহায়ত্বের এক করুণ অধ্যায়। মায়ের মুখে কোনো ভাষা নেই, তিনি যেন বাকরুদ্ধ। যেকোনো কিছু বলতে গেলেই চোখে জল আসে, কান্নায় ভেঙে পড়েন বারবার। পৃথিবীর সব কষ্ট, বেদনা যেন সন্তানহারা এই মায়ের বুকের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে। পিতা প্রবাসে থেকে শুধুই অশ্রুপাত করেন, আক্ষেপ করেন যে, প্রিয় সন্তানের শেষ চেহারাটাও দেখা হয়নি তাঁর। তাদের একমাত্র দাবি, যারা তাদের সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের কঠোর বিচার হোক। এই পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। মাথার উপর একটি স্থায়ী ছাদ নেই, এবং শহীদের ছোট ভাই জাহিদুল ইসলামের কর্মসংস্থানেরও জরুরি প্রয়োজন। পরিবারটির অসহায় চাহনি আমাদের হৃদয়কে বারবার নাড়া দেয়, কষ্টের অনুভূতিতে তারা আমাদের কাছে বিচার ও সহায়তা কামনা করে। এ পরিবারটির যন্ত্রণার গল্প যেন আমাদের সমাজের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি, যেখানে শহীদের স্মৃতি চিরন্তন হলেও পরিবারটি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি শহীদের মা বলেন, আমার নির্দোষ সন্তানকে হত্যার বিচার চাই। যারা সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের কঠোর বিচার হোক। শাকিবের বন্ধুরা বলেন ও নম্র ভদ্র ছিলো। কোন বাজে নেশা ছিলো না। নামাজী ছিলো। ওর এমন নির্মম মৃত্যু কাম্য ছিলো না। যারা হত্যা করেছে তাদের কঠোর শাস্তি চাই। একটি ন্যায্য আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় এমন হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। প্রবাসী পিতার দাবী, সন্তানের শেষ বিদায়ের চেহারাটাও দেখতে দিলো না ওরা পিতার জীবদ্দশায় সন্তানের মৃত্যু কী করে সইব? যারা আমার কলিজার টুকরাকে হত্যা করেছে; তাতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শহীদ শাকিবের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ছিল। তাঁর পিতা, আব্দুল লতিফ, জীবিকার তাগিদে প্রবাসে থাকতেন, কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। পরিবারটি সবসময়ই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল, আর তাই সাকিবেরও স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে পরিবারের অভাব দূর করা। প্রবাসে যাওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এর মধ্যেই জীবনের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি ঘটে। পরিবারের অর্থনৈতিক দুঃখ-কষ্ট সাকিবকে মানসিকভাবে সবসময়ই তাড়া করত, কিন্তু তবুও তিনি স্বপ্ন দেখতেন—একদিন পরিবারকে এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করার। প্রস্তাবনা পরিবারটির সহযোগিতা প্রয়োজন আছে। একটি অসহায় পরিবারের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হল: প্রথমত, তাদের জন্য একটি স্থায়ী ও নিরাপদ বাসস্থানের প্রয়োজন রয়েছে, কারণ বর্তমান জরাজীর্ণ ঘরটি তাদের জীবনযাত্রার মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। একটি নতুন ঘর তাদের নিরাপত্তা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং মানসিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, পরিবারের ছোট ভাই জাহিদকে একটি ভালো চাকরির ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাহিদ একটি চাকরি পেলে পরিবারটির আর্থিক দুরাবস্থা কিছুটা কমবে এবং তাদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলো মেটাতে সহায়ক হবে। এক নজরে শহীদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নাম : জাকির হোসেন (শাকিব) জন্ম তারিখ : ২১-০৫-২০০৫ জন্মস্থান : ফেনী পেশা/পদবী : ড্রাইভার নিজ জেলা : ফেনী পেশাগত পরিচয় : ড্রাইভিং স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মান্দানা, ইউনিয়ন: বগাদানা, উপজেলা: সোনাগাজী, জেলা: ফেনী বর্তমান বাসা/মহল্লা : মান্দানা, এলাকা: সোনাগাজী, জেলা: ফেনী পিতার নাম : আব্দুল লতিফ, প্রবাসী মাতার নাম : কহিনুর আক্তার, গৃহিণী শহিদের সাথে সম্পর্ক : মা সদস্য সংখ্যা : ৩ ভাই-বোনের বিবরণ নাম : জাহিদুল হাসান, বয়স: ১৬ পেশা : টেইলর, ছোট ভাই নাম : জুনায়েদ ইসলাম, বয়স: ৬, ছোট ভাই ঠিকানা : গ্রাম: মান্দারী, ইউনিয়ন: বগাদানা, উপজেলা: সোনাগাজী, জেলা: ফেনী ঘরবাড়ি ও অর্থনৈতিক অবস্থা : ঘর নির্মাণ প্রয়োজন আহত ও শহিদ হওয়ার তারিখ : ৪ আগস্ট ২০২৪ শহিদ হওয়ার স্থান : মহিপাল, ফেনী মৃত্যুর সময় : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ২: টা