জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : দিনমজুর, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মো: আসিফ হোসেন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মীর আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো: মোরশেদ আলম এবং মাতার নাম মৃত আয়েশা খাতুন। তিনি পেশায় একজন দিনমজুর। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশের মানুষের ওপর অন্যায়ের যে স্টিমরোলার চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল আপামর ছাত্র-জনতা। সেই আন্দোলনকারীদের একজন ছিলেন শহীদ আসিফ হোসেন। মানুষের মুক্তির আন্দোলনে এই বীর আমাদের প্রেরণা যোগাবে অনন্তকাল। সহজ-সরল শহীদ আসিফ সহজ সরল একজন দিনমজুর জনাব মো. আসিফ হোসেন। পেটের ক্ষুধা, মনের ব্যথা ঢেকে রাখা সদা হাস্যোজ্জ্বল বোকা-সোকা এই ব্যক্তিকে সবাই ভালবাসতো কেবলমাত্র তার সরলতা আর সততার জন্য। এমনকি এলাকার ছোট বড় অনেকেই শহীদ আসিফের সাথে দুষ্টামি করতো। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কথায় তাঁকে খোঁচাতো, মজা করতো। উদার মনা আসিফও প্রাণ ঢেলে তাদের ভালোবাসা দিতেন। জীবনের না পাওয়া দুঃখটুকু ভোলার চেষ্টা করতেন। অন্যদের দুঃখও ভুলিয়ে দিতে চাইতেন। তাই কখনো কারো সাথে রাগ করতেন না। আর রাগ কেন করবেন? তিনি তো একজন দিনমজুর। আপামর জনতার নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী। রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে, অলি-গলিতে এক কথায় ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী। তাই তিনিই তো ভালো বুঝেন আমজনতার পালস; তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। আন্দোলনের প্রেক্ষাপ্ট ২০২৪ সালের জুলাই মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, রাজপথে বিভিন্ন রকম শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিং, শোডাউন করে যাচ্ছে। ১৬ জুলাই স্বৈরাচার সরকার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে চালায় গুলি। রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদসহ সারাদেশে অন্তত ৬ জন শিক্ষার্থী শহীদ হয়। আহত হয় শত শত শিক্ষার্থী। মৌচাকে ঢিল মারার মত বোকামি করল মাথামোটা আওয়ামী সরকার। একবার দুইবার নয়, বারবার বহুবার। গুলি খেয়ে ফুঁসে উঠে সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয় তাদের সাথে। দাবি আদায় না করে তারা ঘরে ফিরবে না। চার বছর আগে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে স্কুল কলেজের ছোট ছোট বাচ্চারা তখন ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছিল সুশৃংখলভাবে। তারা গাড়ির কাগজ, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় আটকিয়ে দিয়েছিল পুলিশ আর র্যাবের গাড়িও! এক প্রকার নাকানিচুবানি দিয়ে ছেড়েছিল স্বৈরাচারী হাসিনার প্রশাসনকে। সেই চার বছর পর আজ আরো পরিপক্ক হয়েছে তারা। সিনিয়রদের সাথে মিলে গড়ে তুলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেমন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠছে খুনি হাসিনার পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াট, আনসারবাহিনী তেমনি শিক্ষার্থীদের রক্তে হলি খেলায় মেতে উঠেছে। ১৬ জুলাইয়ের পর প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, হোস্টেল, বাসা-বাড়ি সবকিছু। ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের উপর ম্যাসাকার করে কারফিউ জারি করে আর ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় খুনি হাসিনা। তারপর জায়গায় জায়গায় চালায় গোপন গণহত্যা, গণকবর আর রাতের আধারে ২৫ মার্চের কাল রাতের মত গণ গ্রেপ্তার। একদিকে কারফিউর কারণে সাধারণ মানুষ ঘরবন্দি অন্যদিকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনতা স্বৈরাচার সরকারের গোপন অপকর্মের কোন কিছুই জানতে পারলনা। এক সময় কারফিউ তুলে নিলে ব্যাপকভাবে শিক্ষার্থীরা আবারও রাজপথে নামে। আবারও শুরু হয় খুনি হাসিনার ম্যাসাকার। বিশ্ব বেইমান হাসিনার ইশারায় চলে আদালতে দাবি মেনে নেওয়ার নাটক। অবশেষে জনতার রোষানলে এবং আন্তর্জাতিক চাপে ইন্টারনেট চালু করে দেয় আওয়ামী সরকার। অতঃপর বাংলাদেশের মানুষের সাথে সারা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে যে, কারফিউ দিয়ে আর ইন্টারনেট বন্ধ করে কিভাবে শিক্ষার্থীদের গণহত্যা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ছবি আর ভিডিও পৌঁছে যায় মানুষের হাতে হাতে। সাধারণ জনতা আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। জনস্রোত হয়ে নেমে আসে রাস্তায়। এবার শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেন শিক্ষক-শিক্ষিকা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, মুটে-মজুর, শ্রমজীবীসহ বাংলার আপামর জনতা। শুরু হয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন। স্বৈরাচার খুনি হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোন অস্ত্র বাকি রাখেনি যা আন্দোলনকারীদের উপর প্রয়োগ করেনি। কেবলমাত্র স্বৈরাচারীর সীল মারা তাদের নিজস্ব কিছু পাপাচারীদের বাদে যেখানে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে তাকে সেই অবস্থায় গুলি করে, পিটিয়ে, কুপিয়ে খুন করেছে রক্তপিপাসু হাসিনার প্রশাসন এবং তাদের চরিত্রহীন লম্পট গুন্ডা পেটোয়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর আওয়ামী লীগ। শাহবাগী নাস্তিক আর ওলামালীগদেরও নামিয়েছে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে। হেলিকপ্টার দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি করে মেরেছে সাধারণ মানুষ। রক্ষা পায়নি ঘরের ভিতরে খেলতে থাকা ছোট ছোট শিশু বাচ্চারাও। খুনি হাসিনার গুলি খেয়ে নিজের পুতুলের সামনে লুটিয়ে পড়েছে নাবালক শিশুরা। দেশের এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে নড়ে ওঠে দেশের অতি সাধারণ নাগরিক দিনমজুর আসিফের হৃদয়। শত সহস্র প্রশ্ন জাগে তাঁর মনে। আন্দোলনে যোগদান এই লাশের নগরী; এই মৃত্যু বিভীষিকাময় দেশ; এই আস্থাহীন অবিশ্বাসের রাষ্ট্র; এই রক্ষকরুপী ভক্ষকদের উল্লাসমঞ্চ; রক্তে রঞ্জিত রাজপথ; মজলুমের আহাজারিতে পরিপূর্ণ আকাশ; হতাশা,অভিশাপ মিশ্রিত বাতাস; এই গজবের মহাদেশ কি তাঁর প্রিয় জন্মভূমি? তার বাংলাদেশ? প্রতিনিয়ত এমন রাক্ষসের কামড় খাওয়া আর কত? রক্ত পানি করা উপার্জনের ভাগ ঘুষখোর হারামখোর ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হবে আর কতকাল? রাস্তা ঘাটে অলিতে-গলিতে সারাদিনের কামাই ছাত্রলীগ যুবলীগ ছিনতাইকারীদের, চাঁদাবাজিদের হাতে তুলে দিতে হবে আর কত? বৃদ্ধ বাবা-মা টাকার অভাবে চিকিৎসাহীনতায় ভুগবে আর কত দিন? ভাই-বোনদের সামনে ব্যর্থতার লজ্জিত মুখ আর কত দিন? বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরনের এই সংগ্রাম আর কতদিন? আর কতকাল? সরল সহজ আসিফ হোসেনের মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু উত্তর কোথায়? উত্তর আসে রাজপথ থেকে! উত্তর আসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে! উত্তর আসে একের পর এক মৃত্যু থেকে! উত্তর আসে শহীদি মিছিল থেকে! উত্তর আসে দেশব্যাপী বৈষম্যের অরাজকতা থেকে। একদিকে ঘরে খাবার নেই। অপরদিকে রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। বের হলেই গুলি! পাখির মতো গুলি করে ওরা মানুষ মারে! সাপের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে ওরা মানুষ মারে! কসাইয়ের মত কুপিয়ে কুপিয়ে ওরা মানুষ মারে! হয় ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে না খেয়ে মরতে হবে নাহয় রাস্তায় গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে হবে। বেঁচে থাকার আর কোন উপায়-ই যেন ওরা খোলা রাখলো না সাধারণ মানুষের জন্য। এই যখন দেশের অবস্থা; এটাই যখন নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষের বাস্তবতা তখন আসিফ হোসেনের মত এক সাধারণ দিনমজুরের জেগে ওঠাও অবান্তর নয়; অবাস্তব, অকল্পনীয়, অযৌক্তিক নয়। এটা সময়ের অপরিহার্য দাবি; যৌক্তিক বাস্তবতা। অতঃপর শহীদ আসিফ হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। তিনি যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন তথা জুলাই বিপ্লবে, সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে। যেভাবে শহিদ হন মোহাম্মদ আসিফ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণিত নারী শাসক খুনি শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার পূর্বে তিনি বাংলাদেশে চালিয়ে যান ইতিহাসের ঘৃণিত বর্বরোচিত গণহত্যা। সে-ই গণহত্যার ধারাবাহিকতায় সোনাইমুড়ি থানা পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন আসিফ হোসেন। পুলিশ খুনি হাসিনার নির্দেশে এই দেশের গণমানুষের আকাঙ্খার বিরুদ্ধে গিয়ে যে শত শত মানুষ হত্যা করে তারই একজন আসিফ হোসেন। আসিফদের তাজা রক্তেই আমরা পেয়েছি নব স্বাধীনতা। নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আসিফদের রক্তের ঘ্রাণ অনুভব করি। দীর্ঘ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বেডে মৃত্যূ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ১৫ আগস্ট আসিফ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। কেমন আছেন শহিদ আসিফের হোসেনের পরিবার যে আসিফ অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সেই আসিফের পরিবার এখন অর্থনৈতিক দৈন্য দশায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়। নিষ্ঠুর অভাব আসিফদের পরিবারের পিছু ছাড়ে না। ভোর হয়, সূর্য ওঠে, পৃথিবী তার আপন গতিতে চলে কিন্তু দারিদ্রতা তাদের পিছু হটে না। আমাদের উচিৎ আসিফদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। শহীদ সম্পর্কে বক্তব্য প্রতিবেশি ঔষধ ব্যবসায়ী আবদুল হালিম জানান, আসিফের বাড়ি আমার ফার্মেসির পাশেই। সে ও তার বাবা দিনমজুর। আসিফ কেন্দুরবাগ বাজারে রডমিস্ত্রীর কাজ করতো। সে অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিলো। সে সবার সাথে মিলেমিশে থাকতো। কারো সাথে খারাপ আচরণ করতো না। স্থানীয় ইউনিয়ন ৫ নং ওয়াডের মেম্বার ও প্যানেল চেয়ারম্যান ফয়েজ আহম্মদ জানান, আসিফ অনেক ভালো ছেলে। তাঁর জানাজায় বন্যার মধ্যেও অনেক মানুষ হয়েছে। পারিবারিক আর্থিক অবস্থা অর্থনৈতিকভাবে খুবই অস্বচ্ছল। শহীদের পিতা ডেকোরেটরের হেলপার হিসাবে কাজ করেন। দুই ভাই ব্যাগ কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করে সংসার চালায়। পরিশেষে বলা যায়, পরিবারটি খুবই অস্বচ্ছল এবং দরিদ্র, কোনও সংগঠন বা সংস্থা থেকে এখনও কোনো সহযোগিতা পাননি। এক নজরে শহীদ মো: আসিফ হোসেন নাম : মো: আসিফ হোসেন পেশা : দিনমজুর জন্ম তারিখ : ০১/০২/২০০১ আহত ও শহিদ হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, সন্ধ্যা ৭ টা, ১৫ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শহিদ হওয়ার স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দাফনের স্থান : নোয়াখালী কবরের জিপিএস লোকেশন : https://maps.app.goo.gl/3m8iZ28hvwefppVh9 স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মীর আলীপুর, উপজেলা, বেগমগঞ্জ, জেলা, নোয়াখালী পিতা : মো: মোরশেদ আলম মাতা : মৃত আয়েশা খাতুন ঘরবাড়ি ও অর্থনৈতিক অবস্থা : অসচ্ছল ভাই-বোনদের বিবরণ : ভাইয়েরা শ্রমিক প্রস্তাবনা-১ ১. বাসস্থান প্রয়োজন ২. মা (সৎ মা) অসুস্থ থাকায় চিকিৎস্যার ব্যবস্থা করা প্রস্তাবনা-২ ১. বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে ২. ঘর তৈরীতে সহযোগিতা করা ৩. ছোট ভাই-বোনদের লেখা-পড়ার খরচ যোগানে সহযোগীতা করা যেতে পারে। ভাইদের ব্যবসায় সহযোগিতা করা যেতে পারে।