জন্ম তারিখ: ১ আগস্ট, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা : ব্যবস্থা, শাহাদাতের স্থান : রংপুর মেডিক্যাল
মানিক মিয়া রংপুর জেলার কতোয়ালি থানার ঘাঘটপাড়া গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। ১৯৮৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এক দরিদ্র পরিবারে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া ৪ ভাই ও বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ২য় সন্তান । পারিবারিক অভাব অনটন যেখানে নিত্যদিনের ঘটনা নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেথানে শিক্ষা অর্জন ছিল তাদের কাছে দু:স্বপ্নের মতো। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা মানিক মিয়া ছোটকাল থেকেই অন্যের বাড়িতে কামলা দিতেন। মাঠে কাজ করতেন। তিনি ছোট বেলাতেই বাবার সাথে পরিবারের হাল ধরেন। তার বাবা দীর্ঘদিন মৃত্যু শয্যায় বিছানায় পড়ে পড়ে ছিলেন। ২০ বছর বয়স থেকে তিনি পরিবারের আয়ের প্রধান কর্তা হিসেবে কাজ করেন। আয় হলে পরিবারের সবার মুখে খাবার জুটতো আর আয় না হলে কখনো একবেলা আবার কখনো বা না খেয়েই অনাহারে দিন কাটাতে হত। বর্তমানে শহীদ মানিক মিয়ার বাড়িতে টিন দিয়ে ঘেরা ১টি ঘরে মা, স্ত্রী ও তার ১৭ মাসের সন্তান সহ একসাথে বসবাস করেন। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করতেন শহীদ মানিক মিয়া। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মানিক মিয়া ছোট সন্তানের খরচ, মায়ের ঔষধ ক্রয়, পারিবারিক খরচ সব কিছু তিনি ছোট্ট একটি চায়ের দোকান আর অটো চালিয়ে যা ইনকাম হতো তাই দিয়ে চালাতেন। জীর্ন শীর্ন বাড়িতে বসবাস উপযোগী নয়। নীচে কাচা মাটির মেঝে উপরে ও চারদিকে অনেক পুরোনো জং ধরা টিনের বাড়ি, বৃষ্টি এলেই পানিতে ভিজে যায় ঘরের মেঝে।পরিবারের ভরণপোষণ এখন প্রায় হুমকীর মুখে। তার অকাল মৃত্যুতে পরিবার আজ দিশেহারা। মানিক মিয়ার শাহাদাতের দিন যা ঘটেছিল মানিক মিয়া লেখাপড়া খুব বেশি করতে না পারলেও সত্য মিথ্যার পার্থক্য সে করতে পারত অনেক ভালোভাবে। পৃথিবীর বুকে অনেক শিক্ষিত মানুষ আছে কিন্তু মনুষ্যত্ব নেই আবার অনেক মানুষ আছে যাদের অক্ষর জ্ঞান নেই কিন্তু মনুষ্যত্বের দিক থেকে তারা অনেক উপরে। যার বাস্তব প্রমাণ আমাদের দেশের সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ যুবলীগ এবং তাদের বাছাই করা কিছু পুলিশ সদস্য যাদের মানবতা বলে কিছুই নেই। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জায়গায় ধর্ষণে সেঞ্চুরি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। যারা বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদেশী শত্রুদের সাথে হাত মেলায়। গত ১৫ বছরে যারা প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য যারা স্বনামধন্য সেনার সদস্যদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। মানিক মিয়া ছিলেন এদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। সকল সময় সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। অবশেষে দেশকে পুনরায় স্বাধীন করতে সে তার নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিলেন।১৮ জুলাই ২০২৪ রোজ বৃহিস্পতিবার একটি সুন্দর সকাল । সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের তুমুল আন্দোলন চলমান। রংপুর পূর্ব ঘাঘটপাড়ার শহীদ মানিক মিয়া তিনি সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান নিজের চায়ের দোকানে সকাল ১১:০০ পর্যন্ত তিনি দোকানেই ছিলেন ।তিনি আন্দোলনের সাথে যুক্ত পরিচিত ছাত্রদের কাছ থেকে আন্দোরনের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। বেগম রোকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহত হবার খবর শুনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি দোকান বন্ধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহায়তায় মর্ডান মোড়ের আশা নামক এনজিও প্রতিষ্ঠানের সামনে উপস্থিত হন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পানি স্যালাইন কিনে আন্দোলনকারীদের খাওয়াচ্ছিলেন। আহত শিক্ষার্থীদের রিকশায় তুলে দেয়ার কাজও তিনি করছিলেন। সহায়তার এক পর্যায়ে দুপুর ২.০০ টায় তিনি পুলিশের টিয়ারগ্যাসে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু তার মন পড়েছিল সেই শিক্ষার্থীদের মিছিলে। বাড়িতে দেড় ঘন্টা অবস্থানের পর তিনি পুনরায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দেন। এ সময় পুলিশের সাথে শিক্ষার্থী, জনতার সংঘর্ষের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিকেল নাগাদ পুলিশ শটগান দিয়ে অন্যায় ভাবে গুলি চালাতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য মতে তিনি আসরের পর আনুমানিক বিকেল ৫.৩০ মিনিটে রংপুর মডেল কলেজ সংলগ্ন ফাতেমা কোল্ড স্টোরেজ এর সামনে গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের গুলিটি তার ফুসফুস ভেদ করে বের হয়ে যায়। আশংকাজনক অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির প্রায় ৩০ মিনিট পর আনুমানিক ৬.৩০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন পর্যন্ত তার লাশ হস্তান্তরে প্রশাসন টালবাহানা করতে থাকে। অতপর ১৯ জুলাই বিকেল বেলা লাশ হস্তান্তর করা হয়। প্রশাসনের চাপে বিকেল ৫.০০ টায় স্থানীয় কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ঘাতক পুলিশের নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলেন এই জনদরদী মানুষটি। তিনি আর ফিরে আসবেন ন্ াতার ছোট ১৭ মাসের সন্তান চিনতেই পারলনা তার বাবার মুখটি। শহীদ মানিক মিয়ার স্বপ্ন মানিক মিয়ার স্বপ্ন ছিল তার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে। এর আগে পরপর তিনটা সন্তান হয়ে মারা যাওয়ার পর আবার এক সন্তান হয়। সন্তানের নাম রাখা হয় মিনহাজুল ইসলাম সিয়াম। মানিক মিয়ার স্বপ্ন তার ছেলেকে সে অনেক দূরের কোন এক ভালো মাদ্রাসায় লেখাপড়া করাবেন। তার স্ত্রী দূরের মাদ্রাসায় না দেয়ার পরামর্শ দিলে মানিক মিয়া বলতেন জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদের নবী সুদূর চিন পর্যন্ত যেতে বলেছে। আর আমার সন্তানকে কাছে পড়ালে সে ভালো করে পড়বে না। বাবা মায়ের মায়া মহব্বতে থাকলে সন্তানদের ভালো লেখাপড়া হয় না ।তাই দূরের কোন মাদ্রাসায় পড়াতে হবে যেন শুধু লেখাপড়া করে। মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মত যেন বড় হুজুর হতে পারে সেটাই আমার একমাত্র চাওয়া পাওয়া। পারিবারিক অবস্থা শহীদ মানিক মিয়ার একটি ১৭ মাসের সন্তান, মা ও স্ত্রী নিয়ে পরিবারটি খুবই কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। তাদের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি জনাব মানিক মিয়ার শাহাদাতে পুরো পরিবারটি একবারে ভেঙ্গে পড়ে। কি করবে বা কি করতে হবে এমনটিও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের বক্তব্য তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। সমাজের অন্যান্য লোকজনের কোন সমস্যা হলে সবার আগে দৌড়ে যেতেন। অত্যন্ত পরোপকারী ও কোমল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন এই শহীদ মানিক মিয়া। মানিক মিয়া এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন গ্রামের কোন মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির গোসল করানো, কাফন পরানো এবং কবরস্থ করা পর্যন্ত সে সহযোগিতা করত। অর্থনৈতিক সমস্যা থাকার পরেও গরিব-দুঃখীদের সহযোগিতায় সে ছিল অগ্রগামী। এক নজরে শহীদ মানিক মিয়া পূর্ণাঙ্গ নাম : মো: শহীদ মানিক মিয়া পিতা : মো: মৃত সেকেন্দার আলী মাতা : মোসা: নূর জাহান জন্ম তারিখ : ০১-০৮-১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ঘাঘটপাড়া, ইউনিয়ন :রংপুর সিটি কর্পোরেশন, থানা: কোতোয়ালি, জেলা: রংপুর বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: ঘাঘটপাড়া, ইউনিয়ন :রংপুর সিটি কর্পোরেশন, থানা: কোতোয়ালি, জেলা:রংপুর পেশা : চায়ের দোকান শিক্ষাগত যোগ্যতা : ৫ম শ্রেণি বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিত স্ত্রী : মুন্নি আক্তার (২৬) গৃহিণী সন্তান : মিনহাজুল ইসলাম সিয়াম , ১৭ মাস বয়স আক্রমণের স্থান ওই সময় : রংপুর মডেল কলেজ সংলগ্ন ফাতেমা কোল্ড স্টোরেজ এর সামনে, ১৮-০৭-২০২৪ বিকাল ৫:৩০ মিনিট শাহাদাতের স্থান ও সময় : রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, ১৮-০৭-২০২৪ বিকাল ৬:৩০মিনিট আক্রমণকারী : পুলিশ দাফন : নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থান