জন্ম তারিখ: ১ ডিসেম্বর, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৬ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
“বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর” আবু সাঈদ (২০০১ - ১৬ জুলাই ২০২৪) ছিলেন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী। তিনি এই আন্দোলনের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে একজন পুলিশ সদস্যের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করে। ব্যক্তিগত জীবন আবু সাঈদ ২০০১ সালে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মকবুল হোসেন এবং মাতার নাম মনোয়ারা বেগম। আবু সাঈদের ছয় ভাই ও তিন বোন ছিল, নয় ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তিনি স্থানীয় জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপরে স্থানীয় খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিক জীবন শহীদ আবু সাঈদের ২ জন মা। নিজের মা- মনোয়ারা বেগম, সৎ মা মৃত মফেলা বেগম। পরিবারের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত ছিল আবু সাঈদ। তার জন্য পুরো পরিবার অপেক্ষা করছিল বড় হয়ে সে সংসারের হাল ধরবে। তারা ছিল ৯ ভাই-বোন। বড় ভাই ভ্যান চালক, অপর ভাই-বোনদের একজন গার্মেন্টস কর্মী, একজন কৃষি কাজ করেন। দুই বোন গৃহিণী, এক বোন পড়াশোনা করেন। অন্য ভাই গ্রামে মুদি দোকান করে সংসার চালান। ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন আবু সাঈদ ছিলেন ২০২৪ সালের বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন কর্মী। ২০১৩, ২০১৮ সালের পর ২০২৪ সালের ৬ জুন আবারো কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক হিসেবে এই আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রংপুর অঞ্চলে কোটা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। আবু সাঈদ আন্দোলনকে বেগবান করতে ১৫ জুলাই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহাকে উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন: “স্যার! (মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা), এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গিয়েছে। কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেচেঁ আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাচুঁন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাড়াঁন। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেচেঁ থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে। অন্তত একজন ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের। ” ১৬ জুলাই দুপুর ১২টা থেকেই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে কোটা আন্দোলনকর্মীরা বিক্ষোভ করছিলো। আবু সাঈদ এই আন্দোলনের সম্মুখ ভাগেই অবস্থান করছিলো সব সময়। দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে ঘাতক পুলিশ বাহিনী। ছাত্রদের সবাই স্থান ত্যাগ করলেও আবু সাঈদ স্থান ত্যাগ করেনি। সে হাতে একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ এই অবস্থায় তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। সংঘর্ষ শুরু হলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আবু সাঈদ। অন্যরা একটু পেছনে ছিলেন। আবু সাঈদের ঠিক সামনে অবস্থান ছিল পুলিশের। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। উল্টো দিক থেকে রাবার বুলেট ছুঁড়ছিল পুলিশ সদস্যরা। তারপরও নিজ অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ, দাঁড়িয়েই ছিলেন, তাঁর হাতে ছিল একটি লাঠি। তিনি সেই লাঠি দিয়ে রাবার বুলেট ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। একপর্যায়ে শরীরে একের পর এক রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবু সাইদের মৃত্যুর পরেই মূলত আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে। প্রতিক্রিয়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ছেলেটার কাছে যেহেতু প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ছিল না, কাজেই পুলিশের সহিংস হওয়ার কোনও দরকার ছিল না, কিন্তু পুলিশ সেটি না করে গুলি ছুঁড়ে। নিরীহ মানুষের উপর এমন আক্রমণ মোটেও মেনে নেওয়া যায় না।” ১৭ জুলাই ভারতীয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ফেসবুকে আবু সাঈদের একটি ছবি পোস্ট করে লিখেন, “আজ, অস্থির লাগছে। আমিও তো সন্তানের জননী। আশা করবো বাংলাদেশ শান্ত হবে।” ২৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ১০ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ আবু সাঈদের বাড়িতে যান। সেখানে ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবারই সন্তান আবু সাঈদ। হিন্দু পরিবার হোক, মুসলমান পরিবার হোক, বৌদ্ধ পরিবার হোক—সবার ঘরের সন্তান এই আবু সাঈদ।” তার বন্ধুরা জানান-অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল স্পস্ট। বলতেন জনগনের ন্যায্য অধিকার আদায়ে যদি শহীদ হতে হয় হবে তবুও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেনা। খুবই ভালো সৎ চরিত্রবান ছেলে ছিলেন আবু সাঈদ। টিউশনি করে নিজে চলতেন এবং পরিবারকেও চালাতেন। দাফন-কাফন ময়না তদন্দের জন্য শহীদ আবু সাইদের লাশ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। দাফন-কাফনের জন্য লাশ নিতে হাসপাতালে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পড়িমসি শুরু করে। এ নিয়ে প্রসাশনের সাথে চলে বাক বিতণ্ডা। অনেক বাধা বিপত্তির পর অবশেষে লাশের ময়না তদন্তের পর শহীদ আবু সাইদের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়্। জানাজা শেষে নিজ গ্রামে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : শহীদ মো: আবু সাঈদ পেশা : ছাত্র, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম: ২০০১ বয়স : ২৩ বছর পিতা : জনাব মো: মকবুল হোসেন মাতা : মোসা: মনোয়ারা বেগম শাহাদাতের তারিখ : ১৬ জুলাই ২০২৪ গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাহাদাতের স্থান : ১৬ জুলাই ২০২৪, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: বাবনপুর ইউনিয়ন: মদনখালী থানা: পীরগঞ্জ, জেলা: রংপুর