জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৮ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : রংপুর মেডিকেল হাসপাতাল
মিরাজুল ইসলামের পরিবার একটি সংগ্রামী পরিবারের উদাহরণ, যারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থানার মহিষখোচা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম বারোঘরিয়াতে বসবাসকারী এই পরিবারটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগ্রামের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবারের কর্তা, মিরাজুলের বাবা আব্দুল সালাম খান, একজন রিকশা চালক। তার বয়স ৪১ এবং তার সীমিত আয়ের মাধ্যমে পরিবারের ভরণ-পোষণ চলছে। প্রতি মাসে তার আয় মাত্র ৯,০০০ টাকা, যা দিয়ে তিনি পরিবারের চার সদস্যের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। মিরাজুলের মা মোসা: মোহসেনা বেগম, বয়স ৩৩, একজন গৃহিণী। তিনি ঘরের সমস্ত কাজ সামলান এবং সন্তানদের দেখাশোনা করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন, কারণ শুধুমাত্র বাবার আয়ের ওপরই পুরো পরিবারের নির্ভরশীলতা। মিরাজুল ছাড়াও পরিবারে আরও দুই ভাই রয়েছে। মিরাজের বড় ভাই মো: মিসবাহুল মিয়া, বয়স ১৮, আদিতমারী জিএস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র এবং ছোট ভাই মো: সিরাজুল ইসলাম, বয়স ১৪, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। দুই ভাই শিক্ষাজীবনে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে, যদিও পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তাদের পড়াশোনায় অনবরত বাঁধা সৃষ্টি হয়। মিরাজুলের জীবন এই গ্রামের একটি সাধারণ ও সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি। তার বেড়ে উঠা গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে জীবনযাত্রা খুবই সাধারণ এবং দৈনন্দিন খাটুনি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। মিরাজুলের মতো একজন মেধাবী ছাত্র গ্রামের মানুষের মধ্যে বিশেষ পরিচিত ছিল তার ভদ্র ও মার্জিত ব্যবহারের জন্য। যদিও পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না, তবুও মিরাজুল ও তার ভাইয়েরা তাদের ভবিষ্যত নির্মাণের লক্ষ্যে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য দিন এনে দিন খায় এবং তাদের জীবনের প্রতিটি দিনই এক নতুন সংগ্রামের চিহ্ন বহন করে। ঘটনার প্রেক্ষাপট মোসা: মোহসেনা বেগম, শহীদ মিরাজুল ইসলামের গর্বিত মা। মিরাজুল তাঁর কাছে ছিল অমূল্য এক সম্পদ। সবসময় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করত। মা বারবার বলতেন, “মিরাজ আমার সোনার টুকরা ছেলে। এত অল্প বয়সেই আমাদের পরিবারের হাল ধরেছিল।” কিন্তু এই কথা বলতে বলতেই তিনি বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ঘটনার দিন ছিল সোমবার, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। মিরাজুল সকালে নাস্তা করে তাঁর খালাতো ভাইকে ফোন করে বলে যে, সে যাত্রাবাড়ি যাচ্ছে আন্দোলনে যোগ দিতে। ফোন রাখার পরই মা মোছা: মোহসেনা বেগম ছেলেকে নিষেধ করেন আন্দোলনে না যেতে, কারণ সরকার ইতোমধ্যে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। তিনি বলেন, “বাবা, আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। পুলিশ গুলি করছে।” কিন্তু মিরাজ বলল, “মা, সারা দেশের ছাত্ররা নেমে গেছে। আমিও ছাত্র, তাই ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনে যেতেই হবে।” সকাল ৯ টার দিকে মিরাজুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর, ১০ টা ১৫ মিনিটে, তাঁর বাবার মোবাইলে অজানা এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে জানায় যে, মিরাজুল যাত্রাবাড়ি থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মিরাজুলের বাবা তখন শনির আখড়ায় রিকশা চালাচ্ছিলেন। স্ত্রীর কাছে ফোন করে জানালেন, তাঁদের ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং তাকে রেডি হয়ে যাত্রাবাড়িতে আসতে বলেন। মোহসেনা বেগম তখন তাড়াহুড়ো করে যাত্রাবাড়িতে পৌঁছান, কিন্তু সড়কে আন্দোলনের কারণে কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁরা ধোলাইপাড় দিয়ে পায়ে হেঁটে ঢাকা মেডিকেলের দিকে রওনা হন। দুপুর ১২ টার দিকে তাঁরা মেডিকেলে পৌঁছান এবং ফোন দিয়ে জানতে পারেন মিরাজুলকে জরুরী বিভাগের গেইটের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেন, মিরাজুল রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, কিন্তু হাসপাতালে ভিড়ের কারণে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে ৩৫ মিনিট পর ডাক্তার এসে তাঁর রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গুলিটি এমন জায়গায় লেগেছিল যে, চিকিৎসকরা জানালেন, গুলি বের করতে অপারেশন করতে হবে, কিন্তু অপারেশন করতে দেরি হবে। মিরাজুলের বাবা-মা তখন সিদ্ধান্ত নেন, তাকে রংপুর নিয়ে যাবেন। দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে একটি এম্বুলেন্স ভাড়া করে মিরাজুলকে রংপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সারা ঢাকা শহরে আন্দোলনের জন্য রাস্তায় যানজট ছিল। রংপুর পৌঁছাতে তাঁদের রাত ১০ টা বেজে যায়। রংপুর মেডিকেলে মিরাজুলকে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ৩ দিন ধরে মিরাজুল ব্যথায় কাতর হয়ে শুধু বলত, “মা, তাড়াতাড়ি গুলি বের করতে বলো, আমি বাড়ি যাব।” অবশেষে, ৮ আগস্ট রাত ১ টা ৩০ মিনিটে মিরাজুলের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। অক্সিজেন দেওয়া হয়, কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসকরা জানান, গুলি এমন জায়গায় লেগেছে যে এখন অপারেশন করে বের করা সম্ভব নয়। রাতের এক পর্যায়ে মিরাজুলের শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় এবং কর্তব্যরত চিকিৎসক দুঃখিত কণ্ঠে জানান, “মিরাজ আর আমাদের মাঝে নেই।”মোসা: মোহসেনা বেগমের পক্ষে এটি বিশ্বাস করা ছিল অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অত্যন্ত নির্মম। মিরাজুলকে হারানোর যন্ত্রণা তাঁদের পরিবারকে স্তব্ধ করে দেয়। সকালে এম্বুলেন্সে করে শহীদ মিরাজুলের নিথর দেহ বাড়িতে পৌঁছায়। গ্রামের মানুষ জানাজা ও দাফনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সকাল ১০ টায়, শত শত মানুষ মিরাজুলের জানাজায় অংশ নেন এবং গ্রামের মাটিতেই তাঁর শেষ ঠিকানা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি মিরাজুল ইসলামের ছোট ভাই মো: সিরাজুল ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে জানান, "আমার ভাই আমাকে খুব আদর করতেন। পাশে বসিয়ে অংক করাতেন, স্নেহমাখা হাসি দিয়ে সবসময় আমাদেরকে ভালো রাখার চেষ্টা করতেন। আমরা ৩ ভাই সবসময় মিলে মিশে থাকতাম। এলাকায় তাঁর খুব সুনাম ছিল। সবাইকে ভালোভাবে সম্মান করতেন, কারও প্রতি কোনো অবহেলা দেখাতেন না।"সিরাজুল আরও বলেন, "ঢাকায় চাকরিতে যাওয়ার পরেও ভাইয়া প্রতিদিন আমার সাথে ফোনে কথা বলতেন, কখনও আমার খোঁজ নিতেন, কখনো হাসি-ঠাট্টা করতেন। এখনো মনে পড়ে, ভাইয়ার আদরের কথা। ভাইয়া আমাদের মাঝে নেই; এটা বিশ্বাস করা এত কষ্টের যে আমি তা মেনে নিতে পারছি না।" ভাইয়ের এই অপূর্ণ শূন্যতা সিরাজুলের হৃদয়ে গভীর বেদনা তৈরি করেছে, যা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। শহীদ মিরাজুল ইসলাম ছিলেন দরিদ্র পরিবারের আশার আলো। দুই ছোট ভাই এবং অসুস্থ মা-বাবাকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচ। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল মিরাজুলকে। এসএসসি পাশ করার পর, তার শিক্ষার স্বপ্ন ত্যাগ করে জীবনের প্রয়োজনে ঢাকায় পাড়ি জমাতে হয়। সেখানে একটি ফ্লেক্সিলোডের দোকানে কাজ নিয়ে পরিবারের জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু করত । এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : মিরাজুল ইসলাম পেশা : শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান: মহিষখোচা বহুমুখী স্কুল এন্ড কলেজে। এইচ এসসি ভর্তিচ্ছু স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: বারোঘরিয়া ইউনিয়ন: মহিষখোচা , আদিতমারী, জেলা: লালমনিরহাট : পিতার নাম : আব্দুল সালাম খান (৪১) পেশা : রিক্সাচালক মাতার নাম : মোসা: মোহসেনা বেগম, বয়স: ৩৩, পেশা : গৃহিণী মাসিক আয় : ৯০০০/- আয়ের উৎস: বাবার রিক্সা চালানোর আয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৪ জন ভাই বোনের সংখ্যা : ২ ভাই ১) ভাই: মো: মিসবাহুল মিয়া, বয়স, ১৮, পেশা: শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান: আদিতমারী জিএস স্কুল, শ্রেণি: ১০ ২) মো: সিরাজুল ইসলাম, বয়স: ১৪, প্রতিষ্ঠান: আদিতমারী জিএস স্কুল, শ্রেণি: ৮ম প্রস্তাবনা : ১. শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান ২. শহীদের ছোট ভাইদের পড়াশুনার যাবতীয় খরচ প্রদান ৩. শহীদের বাবাকে স্থায়ীবভাবে কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দেয়া অথবা সি এন জি নিয়ে দেয়া যেতে পারে