জন্ম তারিখ: ২৫ অক্টোবর, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: শিক্ষার্থী ও গার্মেন্টস কর্মী, শাহাদাতের স্থান : সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
সুজন হোসেনের জীবন এক সংগ্রামী ও সাধারণ গল্প। ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর লালমনিরহাট জেলার পশ্চিম সাড়াডুবি গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা মো: শহীদুল ইসলাম ৬৫ বছর বয়সী একজন পরিশ্রমী মানুষ আর মা মোসা: রাজিয়া একজন গৃহিণী। পরিবারের চার সদস্যের মধ্যে সুজন বড়। ভাই-বোনদের দায়িত্বও তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অভাবের সংসারে বড় হওয়া সুজন ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করতে শিখেছিলেন। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে ঢাকায় কাজ শুরু করেন তিনি। নিজের প্রয়োজনের তুলনায় পরিবারের জন্যই বেশি অর্থ পাঠাতেন। এই কঠিন জীবনের মধ্যেও শিক্ষার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট ছিল। একজন কর্মী এবং শিক্ষার্থী হিসেবে তার দ্বৈত জীবন ছিল বাস্তবতার কষাঘাতে ভরা, কিন্তু তবু তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করতেন। দারিদ্রের কষ্ট, কঠোর পরিশ্রম আর পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা সুজনকে একটি বাস্তবিক জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক করে তুলেছিল। ঘটনার প্রেক্ষাপট শহীদ সুজন হোসেনের জীবনের কাহিনী যেন এক অশ্রুসিক্ত পরিহাস। জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়গুলোতে যখন একজন যুবক নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা ও পরিবারকে নিয়ে ভাববে, ঠিক তখনই সুজনের জীবন গতি বদলে গেল পরিবারের অমোঘ দায়িত্বের চাপে। তার বাবা ছিলেন শারীরিকভাবে অক্ষম, যিনি একদিন সংসারের মাথা ছিলেন, আজ সেই মাথার ভার সুজনের কাঁধে এসে পড়ে। পরিবার জীবনের জন্য নিজের সুখ, নিজের স্বপ্ন সবই তিনি ত্যাগ করলেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংসারের চাকা সচল রাখা, তার পরিত্যক্ত বোনকেও তিনি পরিবারের অংশ হিসেবে আদর যত্নে রেখেছিলেন। ঢাকায় এসে একটি গার্মেন্টসে জুনিয়র অপারেটরের কাজ নিলেন, সামান্য বেতনে চলছিল তার জীবনযুদ্ধ। মাস শেষে ৫০০ টাকা নিজের হাতে রেখে, বাকি সব টাকা পরিবারকে পাঠিয়ে দিতেন। অর্থের অভাব থাকলেও তার মনে ছিল না কোনো ক্লান্তি, বরং এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেতেন পরিবারের হাসিমুখ দেখে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা তার শান্ত জীবনের সব কিছুকে এক মুহূর্তে উলটপালট করে দিল। ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল, সেই অভিশপ্ত দিনটি যেন তার জীবনের সব কিছুকে কেড়ে নিল। সকাল ৭:৩০ টায় সুজন তার বন্ধু হাসান মাহমুদ রানাকে ফোন করে বলল, "আজ সেনাপ্রধানের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক আছে। খবর কি বলে আমাকে জানাস।" এভাবে কথা বলে সে ফোন রেখে দিল। পরবর্তী সময়ে, দুপুরে তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট আসে, যেখানে লেখা ছিল, "স্বৈরাচারের পতন হয়েছে।" এই ছোট্ট বাক্যটি যেন তার জীবনের শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়। বিকালের দিকে সুজন একটি ভিডিও শেয়ার করে, যেখানে দেখা যায়, সে ফুটওভার ব্রিজ থেকে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে, আর বলছে, "এখানে আশুলিয়া থানা পুলিশ গুলি করে অসংখ্য মানুষ মারছে।" তার সেই ভিডিও যেন মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। এর কিছু সময় পর, যখন তার বন্ধু মেসেঞ্জারে তাকে ফোন করল, সুজনের ফোন আর রিং হয় না। আশঙ্কা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নেয়। রাতে খবর আসে, সুজন আর নেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এই প্রতিবাদী যুবক। সেই রাতে, সুজনের বাড়িতে শুধু কান্নার শব্দ। সবাই শোকে মুহ্যমান, চোখের জল থামানোর কোনো চেষ্টা কেউ আর করছে না। তার বন্ধু হাসান মাহমুদ যখন রাতে ঘুম ভাঙিয়ে কানে শুনলেন কাঁদার আওয়াজ, তখন তিনি জানতেন, সুজন আর ফিরে আসবে না। অশ্রুসিক্ত মন নিয়ে তিনি নিজেই কবর খননের জন্য এগিয়ে গেলেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও ছাতা টাঙিয়ে কবর খোঁড়া হলো, যেন প্রকৃতিও তার অকাল মৃত্যুতে শোকার্ত। পরের দিন দুপুরে, বৃষ্টির মাঝেই জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মুষলধারে বৃষ্টি যেন থামার নামই নিচ্ছিল না, তবু মানুষ জমায়েত হতে থাকল। শত মানুষের চোখের জল নিয়ে দাফন সম্পন্ন হয় সুজনের। তার মৃত্যুতে সারা এলাকায় এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ সুজন শুধু একজন যুবক ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। গত ১৬ বছর ধরে খুনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলা স্বৈরাচারী শাসন, ভোটের অধিকার হরণ, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম, খুন, গুম—এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক সৈনিক। তার মতো সাহসী মানুষের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকেই নয়, একটি পুরো এলাকাকেই শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। আজ সুজন নেই, কিন্তু তার প্রতিবাদী চেতনা, তার আত্মত্যাগ, তার শহীদ হওয়ার বেদনা যেন সবকিছুই থেকে যায় তার পরিবারের চোখের জলে, এলাকার মানুষের হৃদয়ে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এই দোয়াই আজ সকলের মুখে। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি শহীদ সুজন হোসেন, আমার প্রিয় বন্ধুর নাম, যার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আজও আমার মনে উজ্জ্বল। সে ছিল একজন মিশুক প্রকৃতির মানুষ, হাসিমুখে সারাক্ষণ আমার পাশে থাকতো। যদিও বয়সে সে আমার থেকে চার বছর বড়, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের রসায়ন ছিল অনন্য। সুজনের মনে চলত গভীর চিন্তা তার পরিবারের জন্য, বিশেষ করে ছোট বোনের জন্য। যৌতুকের টাকা জোগাড়ের বিষয়টি তাকে প্রায়ই দুশ্চিন্তায় রাখত। “যৌতুকের এতগুলো টাকা আমি কোথায় পাবো?”—এমন আফসোস নিয়ে সে কথাগুলো বলতো, আর আমি শুধু শুনতে পারতাম, তার যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে পারতাম। সে পরিশ্রমী ছিল অবিরাম। পড়াশোনার পাশাপাশি, স্থানীয় বাজারে মুরগি কেটে বিক্রি করতো, কিন্তু সেই আয় কখনোই যথেষ্ট ছিল না। পরিবারের অসহায় বাবার জন্য সে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল—ঢাকার সাভারে, প্রতিবেশি মামার সহায়তায়। সেখানে কাজ করে সে সংসারের খরচ ভালোভাবে চালাতে সক্ষম হয়েছিল, যেন তার পরিশ্রমের ফলে পরিবারে একটু সুখের আলো ফোটে। কিন্তু সুজনের জীবনের গল্প অন্ধকারে মোড় নেয় যখন সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে যোগ দেয়। ঘাতক পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় সে, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে। সুজনের মৃত্যু শুধু তার পরিবারকেই নয়, আমাদের সমাজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজও যখন তার স্মৃতি আমাকে স্পর্শ করে, তখন মনে হয় সে যেন একজন সাহসী যোদ্ধা, যার হৃদয়ে ছিল নিখাঁদ দয়া। সুজন আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার আদর্শ ও সংগ্রাম চিরকাল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ সুজন হোসেন ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সাভারের জামগড়ায় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন তিনি, পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের খরচ চালাতেন। তাঁর বাবা একজন প্রতিবন্ধী, যিনি বাম হাত ও বাম পায়ের আঙ্গুলে জন্মগত সমস্যার কারণে কোন কাজ করতে পারেন না। ফলে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব সুজনের কাঁধে ছিল। কিন্তু একদিন, অপ্রত্যাশিতভাবে সুজন শহীদ হয়ে যান। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়। এখন তারা চিন্তিত, কিভাবে চলবেন এবং কিভাবে সংসারের খরচ চালাবেন। সুজনের অভাব তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এই দুরবস্থার মধ্যে, তারা আশা করে সমাজ সহায়তা করবে, যাতে তাদের জীবনে কিছুটা আলো ফিরিয়ে আনা যায়। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : সুজন হোসেন জন্ম তারিখ : ২৫/১০/১৯৯৯ পেশা : শিক্ষার্থী ও গার্মেন্টস কর্মী স্হায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: পশ্চিম সাড়াডুবি, ইউনিয়ন : বড়খাতা, থানা: হাতিবান্ধা, জেলা: লালমনিরহাট পিতার নাম : শহিদুল ইসলাম ( ৬৫) মাতার নাম : মোসা: রেজিয়া, বয়স: ৫১, পেশা : গৃহিণী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৪ জন ভাই বোনের সংখ্যা: ২ জন ১) পপি খাতুন, বয়স- ২৩, পেশা - গৃহিণী ২) পাকিজা খাতুন, বয়স- ২০, পেশা- শিক্ষার্থী ঘটনার স্থান : জামগড়া আক্রমনকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪ ইং সময়: সকাল ১০: ৩০ মৃত্যুর তারিখ ও সময় স্থান : ০৫/০৮/২৪ ইং, সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। রাত ৯ টা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : গ্রামে পারিবারিক কবরস্থান প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান ২. বোনের যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা করা ৩. শহীদ পরিবারকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা