জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : শ্যামলী
আল মামুন, শিবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। ঠাকুরগাঁও জেলার ঠাকুরগাঁও সদর থানার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ছিটচিলা গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। গ্রামীণ সবুজ শ্যামল পরিবেশে তার শৈশব কেটেছে, যা তাকে প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় বিকশিত হতে সহায়তা করেছে।তার বাবা, মো. আইনুল হক, বয়স ৬৫, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবসা পরিচালনা করতেন। মাসিক আয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২,০০০ টাকা, যা দিয়ে পরিবারটি কষ্টে সংসার চালাত। তার মা, মোছা: মোকসেদা বেগম, বয়স ৫০, একজন গৃহিণী হিসেবে সংসার সামলাতেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আল মামুন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং ভদ্র স্বভাবের। তার পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হলেও, আল মামুন সবসময় পরিবারের হাল ধরার কথা ভাবতেন এবং পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার প্রতি তার গভীর আগ্রহ এবং দায়িত্বশীল মনোভাব তাকে সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। শহীদ আল মামুন তার গ্রামে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন আদর্শ শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঘটনার প্রেক্ষাপট শহীদ আল মামুন ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বীর যোদ্ধা। তার পরিবার এবং এলাকাবাসী সকলের কাছে মামুন ছিলেন একজন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী যুবক। রাজনৈতিক কারণে ভিন্ন দল করার দরুণ তার পরিবারকে সাঈদ কমিশনারের পক্ষ থেকে নিয়মিত হয়রানির শিকার হতে হয়। পুলিশ দিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করা হতো, এবং মামুন পর্যন্ত তার ঘরে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারেননি। এরই মধ্যে মামুনের পরিবারে আসে নতুন খুশির বার্তা—একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের আগমনে মামুন এবং তার পরিবারে নতুন আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে।কিন্তু সেই খুশির মাঝেই দেশজুড়ে শুরু হয় কোটা বিরোধী আন্দোলন। মামুন এবং তার বড় ভাই সেই আন্দোলনে প্রথম সারিতে অংশগ্রহণ করে। প্রতিদিন তারা একসাথে আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিত। তারা বিশ্বাস করত, এই আন্দোলন দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। ৫ আগস্ট, ২০২৪ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। মামুন অংশ নেয় বিজয় মিছিলে, যা ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি মোড়ে এসে পৌঁছায়। স্থানীয় সাঈদ কমিশনার আন্দোলনকারীদের কাছে আসতে বলে তাদের বসার জন্য তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। আন্দোলনকারীরা ভাবলেন, হয়তো কোনো সমঝোতার প্রস্তাব দিতে চান তিনি। কিন্তু এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক চক্রান্ত। সাঈদ কমিশনার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ঘরে আগে থেকে গ্যাস সিলিন্ডার এবং পেট্রোল রেখে ফাঁদ তৈরি করে। আন্দোলনকারীরা ঘরে প্রবেশ করার পরই তারা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয় এবং আগুনে ঘর ভরে যায়। ভেতরে থাকা আন্দোলনকারীরা দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। এলাকাবাসী দ্রুত আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করে। পথিমধ্যেই ৫ আগস্ট একজন মৃত্যুবরণ করে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আরও একজনের মৃত্যু হয়। আল মামুনকে ঠাকুরগাঁও থেকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু ৬ আগস্ট, ভোর ৬ টায় শ্যামলীর কাছে মামুন তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে শেষমেশ এই বীর শহীদ মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। মামুনের নির্মম মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো এলাকাবাসীকে গভীর শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। এমন নৃশংস এবং পৈশাচিক মৃত্যুতে এলাকাবাসী সাঈদ কমিশনার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি তার পরিবারের সদস্যরা জানান সে ছিল খুবই আনন্দ প্রিয় মিশুক প্রকৃতির মানুষ। আল মামুনের ছোট্ট বাচ্চাটি শুধু আব্বু আব্বু করছে দুধের শিশু। বুঝতেই পারেনি তার বাবা আর ফিরে আসবেনা। তার মতো ভালো ছেলে খুব কমই আছে। কারো কোন সমস্যার কথা শুনলে আল মামুন সবার আগে দৌড়ে যেতো তার সমস্যা সমাধান করতো। তার চাচাতো ভাই ঘটনার সময় তার কাছাকাছি ছিল সেও অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। সে জানায় আমাদের মিথ্যে কথা বলে তার বাড়িতে আলোচনার কথা বলে এই পকিল্পিত ঘটনা সাজিয়েছে। শহীদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ আল মামুনের পরিবারের দারিদ্রের কাহিনী অত্যন্ত বেদনাদায়ক। শহীদ আল মামুনের পিতা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া দেওয়ার ব্যবসার মাধ্যমে সংসারের খরচ চালিয়ে আসছেন, বর্তমানে কঠিন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন। তার মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে তিনি শারীরিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অসুস্থতাজনিত এই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, তিনি সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসা এবং ডেকোরেটরের আয় থেকে প্রতি মাসে ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা উপার্জন করেন। এই আয়ে পরিবারের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহীদ আল মামুনের বড় ভাই মোকসেদ আলী নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের বাসায় গিয়ে টিউশন করিয়ে মাসে মাত্র ৫,০০০ টাকা আয় করেন। এই আয় পরিবারের খরচ মেটাতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। মোকসেদ আলী এখনো অবিবাহিত এবং পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু পরিবারের আর্থিক সমস্যা এতই গুরুতর যে তার আয়ও যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে, শহীদ আল মামুনের মা ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং তার মাসিক চিকিৎসা খরচ ৭,০০০ টাকা। তিনি আগে একবার স্ট্রোকও করেছিলেন, যার কারণে তার শারীরিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। পরিবারে মা ও বাবার নিয়মিত ঔষধের প্রয়োজন, যা তাদের আয় দিয়ে বহন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। এই পরিবারটি শুধু দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে নয়, বরং চিকিৎসার খরচ বহন করতেই দারিদ্রর্যের গভীরে ডুবে আছে। শহীদ আল মামুনের মর্মান্তিক মৃত্যু তাদের জীবনের এই দুঃখ-কষ্টকে আরও গভীর করেছে এবং এই কঠিন পরিস্থিতিতে পরিবারটি ধীরে ধীরে আরও সংকটে পতিত হচ্ছে। প্রস্তাবনা শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক সাহায্য প্রদান। পরিবারের যাবতীয় চিকিৎসার খরচ বিনামূল্যের ব্যবস্থা করা। ছোট ভাইয়ের ভালো চাকরির ব্যবস্থা করা। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: আল মামুন, জন্ম তারিখ: ০১/০১/২০০৫ পেশা : শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান: শিবগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে। এইচ এসসি ভর্তিচ্ছু। স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: ছিটচিলা ইউনিয়ন : মোহাম্মদপুর থানা : ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা: ঠাকুরগাঁও পিতার নাম : মো আইনুল হক, বয়স : ৬৫, পেশা: ব্যবসা মাতার নাম : মোসা: মুকসেদা বেগম, বয়স: ৫০, পেশা : গৃহিণী মাসিক আয় : ১২০০০/- আয়ের উৎস: সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবসা পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন ভাই বোনের সংখ্যা : ১ ভাই ১ বোন : ১) ভাই- মো: মোকদেস , বয়স, ২৫ পেশা: শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান : সরকারি কারমাইকেল কলেজ, শ্রেণি: এমবিএ : ২) মোছা: আনিসা আক্তার, বয়স: ২৩ প্রতিষ্ঠান : ঠাকুরগাঁও ডিগ্রি কলেজ, শ্রেণি: ডিগ্রি