জন্ম তারিখ: ১০ নভেম্বর, ১৯৯৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ভ্রাম্যমান সবজি বিক্রি করতেন, শাহাদাতের স্থান :ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
দেশের জন্য নিবেদিত এক তরুণ যুবক শহীদ মো: শাহাবুল ইসলাম শাওন। যিনি ১৯৯৬ সালে পঞ্চগড় জেলার অন্তর্গত দেবীগঞ্জ থানার মেলাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জনাব মো: আজহার কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং মাতা মোসা: তাসলিমা আক্তার পেশায় গৃহিণী। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই যুবক চার ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ার দরুণ ছোট বোন কেউ শিক্ষার আলো দেখতে পারেনি। সংসারের ভারে খুব অল্প বয়সেই ভার নিতে হয়েছে পরিবারের। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করলেও পারিবারিক শিক্ষা থাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ঢাকায় আসার পূর্বে গ্রামেই এলাকায় এলাকায় কাপড় বিক্রি করতেন। তার এই কাপড় বিক্রির টাকা দিয়ে উপার্জন দিয়ে স্ত্রী ও ছেলের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। যাদের এছাড়াও তার থাকার জন্য একটি ঘর তৈরি করার জন্য । ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য নিয়মিতই গুণতে হতো অনেক টাকা। যা তার এই সামান্য আয় থেকে পরিশোধ করা সম্ভব নয়।তখন তিনি ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার বাইক বাইপাইল এলাকায় তিনি ভ্রাম্যমান সবজি বিক্রি করতেন। টানপোড়েনর সংসারে তার স্ত্রীও এক সংগ্রামী নারী। সে একটি পোশাক শিল্পে কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। উভয়ের অর্থ উপার্জনে ভালই চলছিল তাদের সংসার। যেভাবে শহীদ হলেন শাহাবুল ইসলাম জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। আন্দোলনটি প্রথমে ছিল শুধু একটি যৌক্তিক কোটার সংস্কার আন্দোলন। এজন্য শিক্ষার্থীরা দিনের পরে দিন রাজপথে মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ ইত্যাদি করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোন সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করা হয় না। বরং শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। তারই প্রেক্ষিতে ১৪ তারিখে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে একটি সমাধান চায় শিক্ষার্থীরা। ২৪ ঘন্টার আলটিমেটাম শেষ হলেও রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশে ছাত্রলীগের পেটুয়া সন্ত্রাসী বাহিনী আক্রমণ চালায়। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদেরকে বের করে দেওয়া হয় ক্যাম্পাস থেকে। সারা দেশের ক্যাম্পাস গুলোকে নিরাপত্তার নামে বন্ধ করে দেয় সরকার। ১৬ তারিখে এ উপলক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ ও অন্যান্য সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায় ছাত্রদের উপরে। পুলিশের প্রত্যক্ষ গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন রংপুর জেলার মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় আন্দোলনের তীব্রতা। এত তীব্র আকার ধারণ করে যে সারাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ নেমে যায় রাস্তায়। প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গ্রাফিতি তৈরি, হ্যাশট্যাগ ব্যবহার, বিদেশি মিডিয়ার সংবাদ প্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এর ন্যায্য বিচার দাবি করে সরকারের কাছে। তবুও সরকার এদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ছাত্র-জনতার উপরে ভারী অস্ত্রের আক্রমণ করতে থাকে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে বিশ্বের কাছ থেকে লুকানো হয় নির্মম হত্যাকাণ্ডের চিত্র। তবুও বাংলার বীর সন্তানেরা থেমে থাকেনি তাদের আন্দোলন থেকে। দেশের করুণ পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় এক দফা আন্দোলনের। চার তারিখে ঘোষণা করা হয় পাঁচ তারিখের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি। এই দিনেও আহত-নিহত হয় অসংখ্য মানুষ। নিহতদের মধ্যে অন্যতম পঞ্চগড়ের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি শহীদ মো: শাহাবুল ইসলাম। তিনি চার আগস্ট ২০২৪ তারিখ সকাল ১১ টায় মিছিলে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। যদিও তার স্ত্রী তাকে বলে, তুমি মিছিলে যেও না। পুলিশ গুলি করে করে মানুষ মারছে। তবুও সাহাবুল ইসলাম এক ঘন্টার কথা বলেই বের হয়ে যায়। তবে এক ঘন্টা পরে আর তার বাসায় ফেরা হয়নি। কেননা ১১:৩০ এর দিকে ছাত্র জনতার প্রতিবাদ সমাবেশকে লক্ষ্য করে পুলিশ বৃষ্টির ন্যায় গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন শহীদ সাহাবুল ইসলাম। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি থেকে তার মেঝো ভাই কল দিলে নার্স রিসিভ করে জানায় যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। তার লাশ নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে কর্তৃপক্ষ পুলিশের রেফারেন্স ছাড়া লাশ দিতে অস্বীকার করেন। তার ভাই ধামরাই থানার পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলে পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে নিয়ে যান। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম করে লাশ মর্গে রেখে দেন। পরদিন ৫ তারিখে ধামরাই থানার পুলিশের থেকে ক্লিয়ারেন্স আনতে গেলে দেখতে পান থানায় আগুন জ্বলছে। যার কারণে সেখানে কোন পুলিশ পাওয়া যায়নি। এরপর ১১ আগস্টে ধামরাই থানার একজন পুলিশ সদস্যের নাম্বার নিয়ে তার সাথে কথা বলে বিষয়গুলো খুলে বললে সে ১২ তারিখ সকালে থানায় আসতে বলেন। তখন তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে বাসায় ফেরেন। ১২ তারিখে নিজ গ্রামে জানাজার শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় অনুভূতি শাহাবুল ইসলামের নানা প্রতিবেশী গোলাম মোস্তফা জানান যে, শাহাবুল ইসলাম খুব হাসিমুখী ও মিশুক ছেলে ছিল। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর যে দুই বছর চার মাস বয়সের ছেলে রয়েছে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। আমরা তাঁর হত্যার বিচার দাবি করছি এবং আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন সেই কামনা করছি। পারিবারিক ব্যবস্থা বর্ণনা শহীদ শাহাবুল ইসলাম পেশায় একজন ভ্রাম্যমান সবজি বিক্রেতা ছিলেন। ঋণ করে একটি জমি ক্রয় করেছিলেন। শহীদ হওয়ার পর পরিবারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। পরিবারটি বর্তমানে অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রস্তাবনা ১. দুই বছর চার মাস বয়সী ছেলের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে। ২. গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করা স্ত্রীকে উন্নত মানের সেলাই মেশিন প্রদান করা যেতে পারে। ৩. মাসিক ও এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : শহীদ মো: শাহাবুল ইসলাম ( শাওন ) জন্মতারিখ : ১০-১১-১৯৯৬ ধর্ম : ইসলাম পিতার নাম, বয়স, অবস্থা : মোহাম্মদ আজহার, (৫৭), কৃষক মায়ের নাম, বয়স, পেশা : মোসা: তাসলিমা আকতার, (৫০), গৃহিণী পারিবারিক সদস্য : সাত জন সন্তান : ০১ জন ভাই বোন সংখ্যা : ৪ জন ১. মো: বাদল, বয়স : ৩৭, পেশা: শরবত বিক্রেতা ২. মো: তাহিদুল ইসলাম, বয়স : ৩৩, পেশা: রিকশাচালক ৩. মোছা: সীমা আক্তার, বয়স : ১৫, পেশা: ছাত্রী, শ্রেণি: অষ্টম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মোল্লাপাড়া, ইউনিয়ন: টেপ্রিগঞ্জ, থানা: দেবিগঞ্জ, জেলা: পঞ্চগড় বর্তমান ঠিকানা : এলাকা: বাইপাইল, থানা: আশুলিয়া, উপজেলা: সাভার, জেলা: ঢাকা ঘটনার স্থান : বাইপাইল, আশুলিয়া,সাভার আঘাতকারী : স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার সময় কাল : ০৪ আগস্ট, ২০১৪, সকাল ১১টা ৩০ মিনিট নিহত হওয়ার সময়কাল, স্থান : ০৪ আগস্ট, ২০২৪, ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাত ১০ টা শহীদের কবর : নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থান