জন্ম তারিখ: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: গার্মেন্টস কারখানায় ,জুনিয়র অপারেটর, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ব্রিজ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদের মধ্যে অন্যতম রাশেদুল হক। তিনি ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত নাগেশ্বরী থানার চরকাঠগিড়ি গ্রামে। গ্রামের বাড়িতেই পিতা-মাতার কাছে লালিত পালিত হন এবং প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন।তার পিতা জনাব মো: বাচ্চু মিয়া দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার সম্মানিত জন্মদাতা মা আলেয়া বেগম একজন গৃহিণী। পিতা প্রায় বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার কারণে দিনমজুরের কাজ করে তেমন উপার্জন করতে পারে না। শহীদ রাশেদুল হকের সহোদর কোন বোন না থাকলেও তারা মোট পাঁচ ভাই। পাঁচ ভাই ও পিতা-মাতা সহ মোট সাতজনের পরিবার। ভাই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থতম। তার বড় তিন ভাই রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করে এবং ছোট ভাই একটি টেইলার্স এ কাজ করে। পাঁচ ভাই যে যার মত ঘর ভাড়া নিয়ে ঢাকা শহরে বসবাস করে। তাদের পৈত্রিক কোনো সম্পত্তি না থাকায় দিনমজুরের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাতে হয়। শহীদ রাশেদুল হক শুরুতে গ্রামেই কৃষিকাজ করতেন। আবার বেশ কিছুদিন তিনি টেইলার্সের কাজও করেছেন। তিনি কৃষি কাজ ও টেইলার্সের কাজে খুব সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি কখনো অন্যের সাথে অন্যায় বা অসদাচরণ করতেন না। তার এই কাজের অর্থ দিয়ে পরিবার ভালোভাবে চলছিল না। তাই তিনি অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে তার গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন ঢাকা শহরে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি রুম নিয়ে তিনজন বন্ধু একই সাথে থাকতেন। তিনি যাত্রাবাড়ী থাকলেও নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টস কারখানায় ৩ জুলাই ২০২৪ থেকে জুনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। সর্বশেষ তিনি এই পেশাতেই সততা ও দক্ষতার সাথে নিয়োজিত ছিলেন। শাহাদাতের ঘটনার প্রেক্ষাপট শহীদ রাশেদুল হক জুলাই মাসের শুরুতেই নারায়ণগঞ্জ এ গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করতে এসেছেন। যখন ঢাকা সহ সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই মূলত শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা। কেননা হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটা বাতিল করা পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেন। ৫৬% অযৌক্তিক কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রসমাজ। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন ধীরে ধীরে বেগবান হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কার করা। তবে সরকার ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করেনা। বরং প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে রাজাকার বলে গালি দেন ২০২৪ এর জুলাইয়ের ১৪ তারিখে। প্রধানমন্ত্রীর এমন কটুক্তিকর মন্তব্যের কারণে সারাদেশের ছাত্রসমাজ ফুঁসে ওঠে। ১৫ তারিখে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেন। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলো থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রদের উপর ন্যাক্কারজনকভাবে হামলা চালায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণে আহত হয় অসংখ্য শিক্ষার্থী। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের উপরও আক্রমণ চালায়। গুরুতর আহত হয় অসংখ্য শিক্ষার্থী। আহত শিক্ষার্থীদেরকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করলে সেখানেও আক্রমণ চালায় ছাত্রলীগের গুণ্ডাবাহিনী। এরপর শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী তেমন সুবিধা করতে না পারলে সরকার পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। এরপর হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় সারা দেশের স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়। তারা ভেবেছিল স্কুল প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। তবে ১৬ তারিখেও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে সারাদেশে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। রংপুর প্রতিবাদ সমাবেশের উপরে পুলিশলীগ সরাসরি আবু সাঈদের উপরে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ সহ ৬ জন নিহত হয়। এরপরে সারা দেশের ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগ যুবলীগ আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনীরা শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালায়। ৫ আগস্ট পর্যন্ত অসংখ ছাত্রের উপর নির্যাতন চালানো হয় । শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। সর্বশেষ ৫ তারিখে ঢাকা টু মার্চ কর্মসূচির দিন স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শহীদের ঘটনার বিবরণ শহীদ রাশেদুল হক এলাকায় টেইলার্সের কাজের উপার্জন দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলছিল না। এজন্য তিনি জুলাই মাসে ঢাকায় একটি কাজের সন্ধানে আসেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি টিনশেডের ঘর ভাড়া নিয়ে তিন বন্ধু একত্রে বসবাস করতেন। তারপর তিনি নারায়ণগঞ্জের একটি গার্মেন্টস কারখানায় জুনিয়র অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পান।কিছুদিন পর যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছালে নিয়মিত গার্মেন্টসে যেতে পারতেন না। কিন্তু যখন ১ম কারফিউ ঘোষণা করা হয় তখন তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে নিয়ে আন্দোলনে যাত্রাবাড়ি পয়েন্টে অবস্থান নিতেন। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে যতদিন গার্মেন্টস বন্ধ ছিল ততদিন সে আন্দোলনে যোগদান করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে যখন ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় তখন তাঁরা ৩ বন্ধু মিলে সকাল ১০ টার দিকে শনির আখড়া ব্রিজে ছাত্রদের সাথে লংমার্চ কর্মসূচিতে যোগ দেন। শহীদ রাশেদুল হক লংমার্চ কর্মসূচির মিছিলের সম্মুখে ছিলেন। লংমার্চ কর্মসূচির মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ি ব্রিজের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে বিপরীত দিক থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ছাত্র-জনতার দিকে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করা শুরু করে। পুলিশের ২ টি রাবার বুলেট রাশেদুল হকের কপালে ও মাথায় এসে লাগে এবং একটি গুলি বুকের মাঝ বরাবর ঢুকে পিছন দিয়ে বের হয়ে যায়। স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া পুলিশ লীগের গুলি লাগার সাথে সাথেই রাশেদুল হক মাটিতে লুটিয়ে পরেন। পরে মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা তাকে ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে গেলে সাথে সাথেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপরে ছাত্ররা তাঁর পকেট থেকে মোবাইল বের করে বড় ভাইকে ফোন দিলে বড় ভাই ঘটনাস্থলে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। একপর্যায়ে বড় ভাই বাকি ২ ভাইকে ফোন দিয়ে ডেকে এনে শহীদ রাশেদুলের মরদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় একটি পিকআপ ভাড়া করে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে নিয়ে রওনা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি মো:রফিকুল ইসলাম প্রতিবেশি এক বন্ধু জানান যে, রাশেদুল হক ঢাকায় যাওয়ার আগে এলাকায় কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাশপাশি সে কালীগঞ্জ বাজারে টেইলার্সের কাজও করতেন। এলাকার বিভিন্ন জমিতে কৃষি কাজ করার সময় সে ঠিক মত কাজ করতেন। কারও সাথে টাকা ও কাজ নিয়ে দ্বন্দে¦ জড়াতেন না। বর্ষার মৌসুমে এলাকায় কৃষি কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় সে ঢাকায় চলে এসে যাত্রাবড়িতে টেইলার্সের কাজ শুরু করেন। টেইলার্সের কাজে সুবিধা করতে না পেরে সে নারায়নগঞ্জের একটি গার্মেন্টস এ জুনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজে যোগদান করেন। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ায় কাজও ঠিক মত করতে পারেননি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুড়ান্ত পর্যায়ে গেলে সেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। আমাদের জানা মতে সে আন্দোলনের সম্মুখ ভাগে উপস্থিত থাকতেন। সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার কারণে পুলিশের গুলি সরাসরি এসে তাঁর বুকে এসে বিদ্ধ হয়। পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য : শহীদ রাশেদুল হক শাহাদাত বরণের ২২ দিন পূর্বেই বিবাহ করেছিলেন। তার মৃত্যুর তিন দিন পরে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : রাশেদুল হক জন্মতারিখ : ১৮-০২-২০০৪ ধর্ম : ইসলাম পিতার নাম, বয়স, অবস্থা : মো বাচ্চু মিয়া (৫৩) , দিনমজুর মায়ের নাম, পেশা : মোসা: আলেয়া বেগম (৪৭), গৃহিণী পারিবারিক সদস্য : ৭ জন ছেলে মেয়ে : নাই ভাই বোন সংখ্যা : শহীদ ছাড়া ৪ ভাই : ১. ভাই: মো: আলমগীর, বয়স: ৩৬, পেশা: রিকশাচালক : ২. ভাই: মো: আলম, বয়স: ৩০, পেশা: রিকশাচালক : ৩. ভাই: মো: আল আমিন, বয়স: ২৩, পেশা: রিকশাচালক : ৪. ভাই: মো: আপন আহমেদ স্বপন, বয়স: ১৪, পেশা: টেইলার্সের কাজ স্থায়ী ঠিকানা : চর কাঠগিরি, ইউনিয়ন: নুন খাওয়া, থানা: নাগেশ্বরী, জেলা: কুড়িগ্রাম বর্তমান ঠিকানা : যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ব্রিজ আঘাতকারী : স্বৈরাচারীর পালিত পুলিশ আহত হওয়ার সময় কাল : ৫ আগস্ট ২০২৪, সকাল ১১:৩০ মিনিট নিহত হওয়ার সময়কাল, স্থান : শনির আখড়া ব্রিজ যাত্রাবাড়ী, সকাল ১১ টা ৩০ মিনিট শহীদের কবরে বর্তমান অবস্থান : কুড়িগ্রাম, নিজ গ্রামে