জন্ম তারিখ: ১৫ জানুয়ারি, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : শ্যামলী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট
শহীদ মো: গোলাম রব্বানী, কুড়িগ্রাম জেলার কচাকাটা থানার শোভারকুটি গ্রামে ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও, তাঁর জীবনের সংগ্রাম ও সততার কাহিনী অনুপ্রেরণার উৎস। শহীদের পিতা মো: সাইদুল ইসলাম ৫৫ বছর বয়সী, কিন্তু বেকার থাকায় পরিবারের হাল ধরতে পারেন না। তাঁর মা মোছা. আমেনা বেগম একজন গৃহিণী, যিনি পরিবারের যত্ন নেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন, আর বড় বোনও বিবাহিত এবং গৃহিণী। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন গোলাম রাব্বানী। শিক্ষা জীবনে শহীদ গোলাম রব্বানী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন এবং পড়াশোনার পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ করেন। রাজমিস্ত্রির কাজ বেছে নিয়ে তিনি পরিবারের উপার্জন যোগান দেন, উপার্জিত অর্থ বাবার হাতে তুলে দিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটান। তাঁর এই পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধ সত্যিই প্রশংসনীয়। গোলাম নিয়মিত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করতেন এবং মুরুব্বীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তিনি সবসময় সবার খোঁজখবর নিতেন এবং জোরে জোরে সালাম বিনিময় করতেন। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হিসেবে, শহীদের উদ্যম ও আত্মবিশ্বাস সত্যিই অনন্য। গোলাম রব্বানীর সংগ্রামী জীবন, তাঁর পরিবারের জন্য দায়িত্ব ও স্বপ্ন—এসবই তাঁকে সমাজের এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত করেছে। তার জীবন কাহিনী আজকের প্রজন্মের কাছে একটি প্রেরণা, যেন প্রতিটি বাধাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। শহীদ গোলাম রব্বানী, তোমার আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে। শহীদ গোলাম রব্বানীর শাহাদাতের ঘটনা শহীদ গোলাম রব্বানী বয়সে ছোট হলেও তিনি সবসময় পরিবারের পাশে দাঁড়াতেন। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। রাজমিস্ত্রী থেকে উপার্জিত অর্থ বাবার হাতে তুলে দিতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে সে ঢাকায় গিয়ে রাজমিস্ত্রি কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেজন্য তার বন্ধু রাসেলকে ফোন দিয়ে জানায় ঢাকার রাজমিস্ত্রির কাজ করা সম্ভব কিনা। তার বন্ধু সম্মতি দিলে তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় এসে রাজমিস্ত্রীর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন শহীদ গোলাম রাব্বানী। কয়েকদিন কাজ করার পর দেশের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয়। সারাদেশে কারফিউ মোতায়েন করে সেনাবাহিনী ও বিজিবি নামানো হয়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশ ও যুবলীগ সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে অসংখ্য ছাত্র-জনতা কে হত্যা করে। তবুও আন্দোলন দমানো সম্ভব হয় না। বিশ্বের নিকট থেকে আওয়ামী সরকারের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন তথ্য লুকানোর জন্য দেশের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে সৃষ্টি হয় এক ভয়ানক পরিস্থিতি। দেশের মধ্যে গৃহ যুদ্ধাবস্থায় পরিণত হয়। পুলিশ র্যাব বিজিবি একসাথে ছাত্র-জনতার উপরে সরাসরি ও আকাশ পথে গুলি চালাতে থাকে। অসংখ্য নারী পুরুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণে। তবুও দেশপ্রেমী ছাত্র-জনতা দেশকে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পিছপা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সকল জায়গা অনিরাপদ হয়ে যায়। নিজের ঘরেও কেউ নিরাপদ থাকতে পারেনি। ঘরের মধ্যে জানালার ফাঁক দিয়ে গুলি এসেও নিহত হয়েছে অনেকেই। বাসার ছাদে শিশু খেলা করতে গিয়ে উপর থেকে ছোড়া গুলি থেকেও নিহত হয়েছে অনেক শিশু। এমন পরিস্থিতিতে ১৯ জুলাই ২০১৪ রোজ শুক্রবার শহীদ রাব্বানী কাজ শেষ করে বিকাল ৫.৩০ টায় বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়। সে ও তার বন্ধু মিলে রুটি ও কলা ক্রয় করে যেন বাসায় গিয়ে সকলেই একত্রে নাস্তা করতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাদের আর বাসায় যাওয়া হয়নি। কেননা তখন ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। রামপুরা মেইন রোডের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া রব্বানী ও তিন বন্ধু শিকার হয় পুলিশের কালো থাবায়। গোলাম রব্বানী পুলিশের গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দৌড়ে যাওয়ার সময় বিজিবির একটি গুলি তার ডান পায়ের উরুতে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিচ ঢালা কালো রাস্তা রক্তে লাল হয়ে যায়। রাসেল ও স্থানীয় কয়েকজন তাকে নিয়ে বনশ্রী নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে রাব্বির মত আর অসংখ্য ব্যক্তি ইমারজেন্সি রুমের সামনে অপেক্ষা করছে। তারা সেখানে জায়গা না পেয়ে একজন নার্সের পরামর্শে ছোট্ট একটি রুমে নিয়ে গোলাম রাব্বিকে একটি বেডে রাখা হয়। ১০ মিনিট পর ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেন ডাক্তার। এরপর তার বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায় যে, রব্বানী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর দেখতে হয় পুলিশের আরেক নির্মম আচরণ। পুলিশ রাত দশটার দিকে নাগরিক হাসপাতালে অভিযান জ্বালিয়ে কর্তব্যরত ডাক্তারদের শাসিয়ে যান। আহত বা গুলিবিদ্ধ কোন রোগীকে চিকিৎসা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানায় পুলিশ। তবে নার্সকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে অনুরোধ করা হলে তিনি সকাল পর্যন্ত হাসপাতালের তিন তলায় একটি রুমে থাকতে দেন। পরদিন সকাল দশটায় একটি ভ্যান ভাড়া করে কুর্মিটোলা নিয়ে আসা হয় রাব্বিকে।কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে আসার পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভর্তি করিয়ে অপারেশন করার সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিকালের দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে তাঁর ব্যান্ডেজ খোলার চেষ্টা করা হয়। ব্যান্ডেজ খুলতে গিয়েই প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। রক্ত থামাতে না পেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শ্যামলীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এর একজন ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে শ্যামলীতে নিয়ে যেতে বলে এবং ৫ ব্যাগ রক্ত রেডি রাখতে বলে। বিকেল ৫ টার দিকে শ্যামলীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটএ নিয়ে গেলে রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় ডাক্তাররা তাঁকে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া অবস্থায় ডাক্তাররা দেখতে পান রোগী নিস্তেজ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে চেক করে দেখেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারনে রোগী মারা গিয়েছে। তখন উপস্থিত সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এক পর্যায়ে বাড়িতে বিষয়টি জানানো হয় এবং কবর খোড়ার জন্য যাবতীয় প্রস্ততি নেওয়ার জন্য সিন্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাৎক্ষনিক অনেক গুলো এম্বুলেন্স খোঁজ করলে কেউ রাস্তায় সমস্যা হবে বলে ভয়ে যেতে চায় না ,আবার কেউ ভাড়া বেশি চায়। এক পর্যায়ে ২৮০০০ টাকা দিয়ে একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করে রাত ১১ টায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয় বিদারক অবস্থা তৈরী হয়। জানাজায় সৃষ্টি হয় মানুষের ঢল। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি স্থানীয় মসজিদের ইমাম জনাব আবু বকর জানান শহীদ গোলাম রব্বানী পূর্ব খামার ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। পড়াশুনার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরার জন্য এলাকাতে রাজমিস্ত্রীর কাজও করতেন। মাদ্রাসায় পড়ার কারণে সে মসজিদে নামায আদায় করতে আসতেন। মসজিদে বা রাস্তায় আমার সাথে দেখা হলেই জোরে সালাম প্রদান করতেন। ছেলে হিসেবে গোলাম রব্বানী অতুলনীয়। অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরার বিষয়টা সে বুঝেছিলেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে যে টাকা পেতেন তা সরাসরি তাঁর বাবার হাতে দিয়ে দিতেন। তাঁর বাবা ঐ টাকা দিয়ে সংসারের বাজার করতেন। পরিবারের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেতে গিয়েই গোলাম রাব্বানী আজ শহীদ হয়েছেন। আমার মসজিদে তাঁর জন্য দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাকার সকল মুসল্লিরা হাজির হয়ে তাঁর জন্য দোয়া করেছেন। প্রস্তাবনা : শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান : নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য পুরো নাম : শহীদ মো: গোলাম রব্বানী জন্মতারিখ : ১৫-০১-২০০৮ ধর্ম : ইসলাম পেশা : শিক্ষার্থী পিতার নাম, বয়স,অবস্থা : মো: সাইদুল ইসলাম (৫৫), বেকার মায়ের নাম : পেশা: মোসা: আমেনা খাতুন (৪৭), গৃহিনী পারিবারিক সদস্য : ৫ জন বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত ছেলে মেয়ে : নাই ভাই বোন সংখ্যা : চার ভাই বোন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শোভারকুটি, ইউনিয়ন: কচাকাটা,থানা:কচাকাটা, উপজেলা: নাগেশ্বরী, জেলা: কুড়িগ্রাম বর্তমান ঠিকানা : শোভারকুটি, ইউনিয়ন: কচাকাটা,থানা: কচাকাটা, উপজেলা: নাগেশ্বরী, জেলা: কুড়িগ্রাম ঘটনার স্থান : আফতাব নগর, রামপুরা, ঢাকা আঘাতকারী : পুলিশ ও বিজিবি আহত হওয়ার সময় কাল : উনিশে জুলাই ২০১৪, বিকাল ৫ঃ৩০টা নিহত হওয়ার সময়কাল, স্থান : ২০ জুলাই ২০২৪ শ্যামলী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট শহীদের কবরে বর্তমান অবস্থান : কুড়িগ্রামের গ্রামে