জন্ম তারিখ: ১৭ জানুয়ারি, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :হাকিমপুর পৌর মেয়র জাহিদ হোসেন চলন্তর বাসা।
আশাদুজ্জামান নূর সূর্য্য, ২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর পৌরসভা এলাকার বড় ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মো: মজনু এবং মাতা রাজিয়া সুলতানার দ্বিতীয় সন্তান। নূর স্থানীয় জালারপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিকভাবে অসুস্থ বাবার দেখাশোনা করতেন। তার মা রাজিয়া সুলতানা অল্প টাকা বেতনে জুট মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে অতিকষ্টে দুই ছেলেকে বড় করছিলেন। শহীদ নুর অত্যন্ত সহজ-সরল এবং লাজুক প্রকৃতির ছেলে। সবসময় চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার এই সহজ সরল মনোভাব তাকে স্বদেশের প্রয়োজনে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া থেকে আটকে রাখতে পারেনি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। ৪ আগস্ট, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচী থেকে তিনি নিখোঁজ হন। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাকিমপুর পৌরশহরের হিলি বাজারে সাবেক পৌর মেয়র জাহেদ হোসেনের আগুনে পোড়া বাড়ি থেকে আসাদুজ্জামানসহ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শহীদ নূর সূর্যের কবর বর্তমানে তার গ্রামের বাড়ির কাঠি পুকুর কবরস্থানে অবস্থিত, যেখানে তাঁর স্মৃতি চিরকাল জীবিত থাকবে। শাহাদাতের ঘটনা ২০০৮ সালে একটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে হেন কোন উপায় নেই যা তারা অবলম্বন করেনি। শুরুটা হয়েছিল পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা হত্যার মাধ্যমে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের একপাক্ষিক নির্বাচন ও বিনা ভোটে ১৫৩ টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা, ২০১৮ সালের নৈশভোটের তামাশা এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করে। সরকারি চাকরিতে বৈষম্য মূলক কোটা প্রথা আদালত কর্তৃক পুনর্বহাল হলে সারাদেশের ছাত্র জনতা প্রতিবাদ করে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অংশ হিসেবে মিছিল মিটিং, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন সহ বিভিন্ন অহিংস পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। একইসাথে সরকারকে এই ন্যায্য দাবি মেনে নেবার আহ্বান জানাতে থাকে। কিন্তু ক্ষমতার লোভ ও জনগণের সম্পদ লুটপাটের মোহে অন্ধ ফ্যাসিস্ট সরকার ছাত্রদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া তো দূরে থাক উলটো পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের উপর। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়তে থাকে সহিংসতা। ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদ এর মাধ্যমে শুরু হয় শাহাদাতের মিছিল। ঝরে পড়তে থাকে শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীন, ফয়সাল আহমেদ শান্ত, ওয়াসিম আকরাম সহ আরো শত শত মেধাবী তাজা প্রাণ। সরকারের এই হিংস্র ও খুনি প্রতিক্রিয়া দেখে বাংলাদেশের আপামরজনতা বুঝতে পারে সরকারকে আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না । ফলশ্রুতিতে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে পিষ্ট জনগণ যোগ দেয় ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনে। ছাত্রআন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। অবশেষে প্রবল প্রতিরোধ ও হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে খুনি হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর ঠিক একদিন পূর্বে মো: আশাদুজ্জামান নুর সূর্য ৪ আগস্ট ২০২৪ বিকেল ৩ টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবানে গণমিছিলে অংশ নেয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও প্রশাসন যৌথ হামলা চালায়। মিছিলকারীরা এদের হামলায় টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই অতর্কিত হামলায় অনেকেই আহত ও নিখোঁজ হয়। ছাত্র জনতা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলেও আশাদুজ্জামান ও দিনাজপুরের আরেক বীর শহীদ ফাহিমকে এরা ধরে নিয়ে পৌর মেয়রের বাসায় আটকে রাখে, যার খোজ কেউ বলতে পারেনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, তাঁর পরিবার কোন খোঁজ পায়না। শুরু হয় ব্যাপক খোঁজাখুঁজি। প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস সহ সর্বত্র সন্ধান চেয়েও কোথাও খোঁজ মেলে না তাদের। অবশেষে পরদিন খবর মেলে হাকিমপুর পৌর মেয়র আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী জাহিদ হোসেন চলন্তের বাসার ২য় তলার এক রুমে আটকে রাখা হয় মো: আশাদুজ্জামান ও ফাহিমকে এবং সেখানে অগ্নিদন্দ্ব হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তারা। ফায়ার সার্ভিস থেকে কল দিয়ে তার মৃত্যুর সংবাদ পরিবারকে জানানো হয়। পর দিন সকালে বিনা ময়নাদতন্তে আশাদুজ্জামানের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা হাকিমপুর পৌর মেয়র জাহেদ হোসেনের বাড়িতে হামলা করে আগুন লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, আন্দোলনকারীরা যখন ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়, তখন হয়তো আসাদুজ্জামানসহ ওই দুজন বাড়িতে আটকা পড়েছিল। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বের হতে না পেরে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। তবে এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট সকালে আসাদুজ্জামানের বড় ভাই মো. সুজন বাদী হয়ে হাকিমপুর থানায় যে হত্যা মামলা করেন, তাতে ভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে হাকিমপুর পৌর শহরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের নির্দেশে হাকিমপুর উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হিলি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নিচে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নেওয়া আশাদুজ্জামান নূর, নাফিজ, মোস্তাকিম মেহেদী, মহিদুল ও বাবু আহম্মেদকে মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। পরে আসাদুজ্জামানকে ও পরদিন ৫ তারিখ মোহতাসিম হাসান ফাহিমকে পৌর মেয়র জাহেদ হোসেনের বাড়ির টর্চার সেলে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতনের ফলে সেখানে সূর্য ও ফাহিমের মৃত্যু হয়। পরে আসামিরা এ দুজনের লাশ গুম করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে গভীর রাতে নাফিজ, মোস্তাকিম মেহেদী, মহিদুল ও বাবু আহম্মেদ কৌশলে পৌর মেয়রের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নিহত এ দুজনের মরদেহ পুড়িয়ে ফেলে হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে রাতে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌর মেয়র জামিল হোসেনের বাড়ি থেকে আসাদুজ্জামান ও ফাহিমের মরদেহ উদ্ধার করে। দাফনের ১ মাস ৪ দিন পর আসাদুজ্জামান নূর ওরফে সূর্যের কবর থেকে তার মরদেহ উত্তোলন করা হয়। আদালতের নির্দেশে ১০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মরদেহটি উত্তোলন করা হয়। এ সময় উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লায়লা ইয়াসমিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে মরদেহটি কবর থেকে তোলার পর প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠায় পুলিশ। এ সময় হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফুল ইসলামসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। শহীদের নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি ১. শহীদের বড় ভাই সুজন আলী বলেন, 'শহীদ আসাদুজ্জামান অত্যন্ত সহজ সরল লাজুক প্রকৃতির ছিল। সে কারো সাথে ঝগড়া করা তো দূরে থাক উচ্চস্বরে কথাও বলত না। সে লজ্জার কারণে কারো সাথে বন্ধুত্বও করতে পারত না। তার শুধু একটি বন্ধু ছিল পরবর্তীতে তাকেও সে পরিত্যাগ করে, কারণ সে জানতে পারে তার বন্ধুটি সিগারেট খায়। ছাত্র আন্দোলনের সময় তার পরিবারের বাধা ও নিষেধ সত্ত্বেও সে ছাত্রদের মিছিলে অংশগ্রহণ করত। আল্লাহ যেন তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন'। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা : ১. শহীদের মা রাজিয়া সুলতানা জুট মিলে কাজ করতেন, যার আয় দিয়ে অতি কষ্টের সংসার চলত। বর্তমানে ছেলেকে হারিয়ে শোকে প্রায় পাগলপারা। ২. বড় ভাই সুজন আলী বন্দরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। প্রস্তাবনা : ১. শহীদের বড় ভাইকে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য সহযোগিতা করা যেতে পারে। ২. মানসিকভাবে অসুস্থ পিতার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা যেতে পারে একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : আশাদুজ্জামান নূর সূর্য্য জন্ম তারিখ : ১৭-০১-২০০৮ পিতা : মো: মজনু মাতা : রাজিয়া সুলতানা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বড় ডাঙ্গাপাড়া, ইউনিয়ন: হাকিমপুর পৌরসভা, থানা: হাকিমপুর, জেলা: দিনাজপুর পেশা : ছাত্র (৮ম শ্রেণি) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জালারপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ঘটনার স্থান : হাকিমপুর পৌর মেয়র জাহিদ হোসেন চলন্তর বাসা আহত হওয়ার সময়কাল : ৪-৮-২০২৪, বিকাল: ৪:৩০টা শাহাদাতের সময়কাল : ৫-৮-২০২৪, রাত: ১০টা আঘাতের ধরন : আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা অগ্নিসংযোগ শহীদের কবরের অবস্থান : কাঠি পুকুর কবরস্থান