জন্ম তারিখ: ১২ নভেম্বর, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৯ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রংপুর
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :দিনাজপুর মেডিকেল।
২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শহীদ মো: রবিউল ইসলাম রাহুল। বাবা মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন এলাকায় মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাহুল। পরিবারের সকলের আদরের ছিলেন তিনি। বড় দুই ভাই গার্মেন্টস কর্মী ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করে থাকেন।শহীদ রাহুল ইসলাম দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের বিদুরশাই মহারাজপুর এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি রানীগঞ্জ এহিয়া হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনা আর খেলাধুলাই ছিল তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের কোটাসংস্কারের আন্দোলন শুরু হলে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে রাহুলও তাতে জড়িয়ে পড়েন। কোটাসংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতেই তিনি ছিলেন সরব অংশগ্রহনকারী। অবশেষে ৪ আগস্ট ২০২৪ সালে আন্দোলনকারীদের মিছিলে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও ছড়রা গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হয়ে আই সি ইউ তে মৃত্যুবরন করেন। ঘটনার দিন ১৭ বছর বয়সী রাহুলের জন্মের পর থেকেই আওয়ামীলীগ ও তার ফ্যাসিবাদী শাসন দেখেই বড় হয়েছেন। ভিন্নমতের প্রতি দমন-পীড়ন, ট্যাগিং এর মাধ্যমে দিনদুপুরে পিটিয়ে মানুষ খুন, বিরোধী দল ও মতের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার, বাহ্যিক চাকচিক্য ও অভ্যন্তরীণভাবে ফোকলা অর্থনৈতিক অবস্থা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, সীমান্তে মানুষ হত্যা সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক দুরবস্থা একজন রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে রাহুলকে ভাবিয়ে তুলতো। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী নায্য আন্দোলন যখন সরকারের ক্রমাগত অবহেলা ও দমননীতির কারণে বৈষম্যবিরোধী গনআন্দোলনে রূপ নেয়, তখন রাহুল একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আন্দোলনে যোগদান করেন। সুশৃঙ্খল আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, ছররা গুলির ব্যবহার সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ গনআন্দোলনকে ব্যপকভাবে উসকে দেয়। সরকারিভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন, দেশব্যাপী কারফিউ জারি, রাতের অন্ধকারে এলাকাভিত্তিক ব্ল্যাকআউট করে মানুষের বাসায় বাসায় তল্লাশি ও গণ গ্রেপ্তার জনগণের সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করে। ফলশ্রুতিতে বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ সাধারণ জনতা ফ্যাসিস্ট সরকারের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে নেমে পড়ে রাজপথে। যোগ দেয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় গনআন্দোলনে। কিন্তু আন্দোলনে সারা দেশবাসীর প্রবল জনসম্পৃপ্ততাও সরকারের বোধদয় ঘটাতে পারেনি। ক্ষমতার লোভ ও লুটপাটের অন্ধ সরকার আন্দোলনকে দমাতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে। হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ চুরি, হত্যা করে লাশ জ্বালিয়ে দেওয়া, গণকবর, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে নিজ দেশের জনগণের উপরই গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ সহ হেন কোন অপরাধ নেই যা খুনি হাসিনা সরকার আর দোসর আওয়ামী বাহিনী করেনি। কিন্তু এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারে তাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। এই বাংলার মানুষ তাদের আর কোনভাবেই মেনে নিবে না, তখন তারা মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত হয়। নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে নিজের দেশের মানুষকেই। কিন্তু তবুও মানুষকে তারা দমিয়ে রাখতে পারেনি। ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেয় রবিউল ইসলাম। ছাত্র আন্দোলনে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছিল রাহুল। দুপুরের কিছু সময় পর দিনাজপুর শহরের হাসপাতাল মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ অবস্থান নেয় পৌরসভা রেলক্রসিং এলাকায়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিলে আন্দোলনকরীরা জজকোর্ট গেটে অবস্থান নেয়। পুলিশ জর্জকোট গেট খুলে অনবরত গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়তে থাকে। এ সময় পুলিশের একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল রাহুলের সামনে এসে পড়ে। পরে পুলিশের ছড়রা গুলিতে আহত হন তিনি। তাৎক্ষণিক তাকে দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার শরীর থেকে গুলি বের করেন চিকিৎসকেরা। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় চলে আসেন। পরবর্তীতে আঘাতের স্থানে সংক্রমণ হলে পুনরায় তাকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তাকে আই সি ইউ তে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালের আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, রাহুলের ঊরুতে ছররা গুলির চিহ্ন আছে। তার শ্বাসকষ্টও ছিল। গত বুধবার আনুমানিক রাত আটটায় অচেতন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়। তার রক্তচাপ খুব কম ছিল, জ্বরও ছিল। মস্তিষ্কে ইনফেকশন ধরা পড়েছিল। দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় (শুক্রবার) সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় তার মৃত্যু হয়। নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি ১. মায়ের অনুভূতি : ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল। আমার ছেলে তো চলেই গেছে, আর ফিরে পাবোনা। ২. পিতার অনুভূতি : আবু সাঈদ যেদিন মারা যায় আমার ছেলে বলে "দেশ বাঁচাবার জন্য আমিও শহীদ হয়ে যাব আমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা" এদিনই সে মিছিলে চলে যায়। ৩. মেঝোভাই আলামিন বলেন : রাহুল প্রায় সময় বলতো- ‘’এইদেশে কিছুই হবেনা। যেকোন সেবা নিতেই তদবিরের প্রয়োজন হয়। এদেশের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন আমি সেটা করে দেখাবো।‘’ ৪. খালার অনুভূতি : সে অত্যন্ত নিরীহ ছেলে ছিল, পড়াশোনার প্রতি তার ব্যপক আগ্রহ ছিল। তার আশা ছিল পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে। ৫. রবিউল ইসলামের চাচাতো ভাই বলেন : সে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ত। অত্যন্ত ভালো ছিল। পুলিশ এইভাবে গুলিবর্ষণ করে ? মানুষ মারা গণতন্ত্রের লক্ষণ হতে পারে না। ৬. বন্ধু : সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার পরিবার যেন অবহেলার শিকার না হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা : বাবা এলাকায় মাছ বিক্রি করেন। বড় দুই ভাই গার্মেন্টস কর্মী ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করে থাকেন। টিনের জরাজীর্ণ ঘরে বাবা মা বসবাস করেন। প্রস্তাবনা : বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: রবিউল ইসলাম জন্ম তারিখ : ১২-১১-২০০৭ পিতা : মো: মুসলিম উদ্দিন মাতা : ফরিদা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বিদুরশাই, ইউনিয়ন: ৩ নং খাজির বিল, থানা: কোতোয়ালি, জেলা: দিনাজপুর বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত পেশা : ছাত্র ঘটনার স্থান : সদর মেডিকেল মোড়, জজকোর্ট গেইট, দিনাজপুর আহত হওয়ার সময়কাল : ৪-৮-২০২৪, বিকেল ৪টা শাহাদাতের সময়কাল : ৯-৮-২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, দিনাজপুর মেডিকেল আঘাতের ধরন : ছররাগুলি ও রাবার বুলেট আক্রমণকারী : পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : মহারাজ জামে মসজিদ কবরস্থান