Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর

নাম: মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর

জন্ম তারিখ: ১২ মে, ২০০৯

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: রংপুর

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী

শহীদের জীবনী

আর রোবট তৈরি করা হল না অন্তরের। মা’কে বলা হল না শেষ কথা। স্বাধীন দেশ গড়তে নীরবে প্রাণ দিয়ে গেলেন এই যোদ্ধা। যেন দেশ থেকে অপার সম্ভাবনাময় একটি বালক নীরবে ঝরে গেল। ’“বুট দিয়ে তাঁর বুকে কয়েকটি লাথি মারা হয়” শহীদ পরিচিতি জনাব মিজানুর রহমান ও মাতা হামিদা বানুর একমাত্র ছেলে আশরাফুল ইসলাম অন্তর। ২০০৯ সালের ১২ মে দিনাজপুর জেলার বিরল থানার অন্তর্গত করলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবটা সেখানেই কেটেছে অন্তরের। তাঁর পিতা স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মেরামত করেন। তবে নিমিষেই সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় আশরাফুল জননীর। যেন সকল স্বপ্ন মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। তাঁকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন মিজানুর। অবুঝ শিশুর উপর নেমে আসে মানসিক নির্যাতন। অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে ছেলেকে নিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডগাইর নতুন পাড়া এলাকায় বোনের বাসায় চলে আসেন হামিদা বানু। সেখানেই নতুন জীবন শুরু হয় অন্তর ও তাঁর মায়ের। রাজধানীর নিউমার্কেটে একটি পোশাক কাঁরখানায় স্বল্প বেতনে চাকরি নেন তিনি। কারখানা থেকে প্রাপ্ত নাস্তা নিজে না খেয়ে সন্তানের জন্য নিয়ে এসে মাতৃ দায়িত্ব পালন করতেন। হামিদা বানুর ভাষ্যমতে- ‘প্রতিদিন ডগাইর থেকে কামরাঙ্গিরচর কাঁরখানায় যাওয়া-আসা বাবদ চল্লিশ টাকা বাস ভাড়ার প্রয়োজন হতো। আমি দুধের শিশু বুকে করে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। নিজে না খেয়ে সন্তানের জন্য খাবার কিনে দিয়েছি। কখনও অন্তরের বাবা একবারও সন্তানের খোঁজ নেয়নি। আমার ছেলে একটু বড় হলে তাকে স্কুলে ভর্তি করেছি। লেখাপড়া শিখিয়েছি। স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমার ছেলে অনেক বড় হবে। অন্তর আমাকে লাইট-ফ্যান বানিয়ে দিত। ভেবেছিলাম আমার ছেলে একদিন অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। যেই দায়িত্ব ওর বাবার ছিল, সেই দায়িত্ব আমি পালন করেছি। একবারও নিজের সন্তানের খোঁজ করেনি ওর বাবা। আমার ছেলে যখন শহীদ হয়েছে জানার পর, আমি অন্তরের বাবাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম। তখনও আমার সাথে রাগারাগি করেছে ওর বাবা। আমি শুধু চাই- আল্লাহ আমার সন্তানকে যেন জান্নাত দান করেন।” জনাব মিজানুর রহমানের সাথে বিচ্ছেদের পর দীর্ঘ দশ বছর সন্তানকে নিয়ে একাই জীবনযাপন করেছেন হামিদা বানু। বিয়ের সম্বন্ধ আসলেও সন্তানের অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি তিনি। অন্তরের শাহাদতের বছর দুই পূর্বে পিতা-মাতা জোর পূর্বক মুন্সিগঞ্জ জেলার বানিয়াল, আশালিরচর গ্রামের জনৈক ব্যক্তির সাথে মেয়েকে পাত্রস্থ করেন। অন্তর আবারও তাঁর পরিবার ফিরে পায়। কিছুদিন পর হামিদা বানুর কোল জুড়ে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান ফারিয়া (১)। আবারও মাতৃত্বের স্বাদ পান তিনি। বর্তমানে কারখানার কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আবারও পরিবার গড়তে মনোনিবেশ করেছেন শহীদ আশরাফুল ইসলাম অন্তরের জন্মদাত্রী মা হামিদা বানু। বর্তমানে অন্তরের সৎ বাবা মালয়েশিয়া থাকেন। তিনি এক বছর পূর্বে স্ত্রী’র গহনা বিক্রি করা টাকা দিয়ে প্রবাসে গিয়েছেন। দেশে থাকতে ফাস্টফুডের ব্যাবসা করতেন। টুরিস্ট ভিসা নিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানি এখনও তাঁকে ওয়ার্কিং ভিসা দেয়নি। ফলে একপ্রকার অন্তরালে থেকে কাজ করছেন। তিনি মাত্র বিশ হাজার টাকা বেতন পান। যে কারনে সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করা তাঁর পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে পৈতৃক বাড়ী ছাড়া তাঁদের আবাদি কোন জমি নেই। শহীদের সৃজনশীলতা শহীদ হওয়ার পূর্বে আশরাফুল ইসলাম অন্তর ডগাইর বাজার, বাশেরপুল রোড, সারুলিয়া, ডেমরা, ঢাকার সিদ্দিক-ই-আকবর (রা:) ইন্সটিটিউটের সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করতেন। অন্তরের সৃজনশীলতা দেখে যে কেউ মুগ্ধ হত। তাঁর টেকনিক্যাল জ্ঞান খুব ভালো ছিল। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নষ্ট হয়ে গেলে নিজেই ঠিক করে ফেলত। ছোট-ছোট লাইট-ফ্যান তৈরি করে মাকে উপহার দিত। বাড়িতে বৈদ্যুতিক কোন সমস্যা হলে নিজেই সমাধান করত। বার বার মাকে বলত- আম্মু, একদিন আমি রোবট তৈরি করব। আমার রোবট তোমার ঘরের সব কাজ করে দেবে। স্কুল পালিয়ে আন্দোলনের পথে প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি করে অন্তর। একদিন রেগে ভীষণ বকাঝকা করে তাঁর মা। মন খারাপ করে স্কুল ড্রেস পরিহিত অবস্থায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঘুম থেকে ডেকে তোলে হামিদা বানু। ছেলেকে আদর করে বলে- তুমি আমার একটাই ছেলে, তোমার কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচব বাবা। অন্তর মায়ের দিকে তাকিয়ে জানায়- ‘মা আমি আন্দোলনে যাবই, তুমি আমাকে নিষেধ করবে না’ বিজয় মিছিল ও শাহাদতের প্রেক্ষাপট ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনার পদত্যাগে উল্লাসে ফেটে পড়ে সারদেশের জনতা। রাজধানী সহ দেশের সমস্ত অলি-গলি থেকে বিজয় মিছিল বের হয়। তেমনই যাত্রাবাড়ী সংলগ্নে বিজয় মিছিল বের করে স্থানীয় জনতা। মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে মিছিলে অংশ গ্রহণ করেন অন্তর। বিজয়ের পরও যেন হাসিনার পেটুয়া বাহিনী থামতে জানে না। চারিদিকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে ঘাতক পুলিশ বাহিনী। শতশত লাশের রক্তে রঞ্জিত হয় যাত্রাবাড়ীর রাজপথ। হঠাৎ বিকাল ৫.০০ টায় আশরাফুল ইসলাম অন্তর গুলিবিদ্ধ হন। ঘাতকের গুলি তাঁর বক্ষ ভেদ করে পৃষ্ঠদেশ অতিক্রম করে। সাথে সাথে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়দের মতে পুলিশ বাহিনী সর্বপ্রথম ‘অন্তরকে পা দিয়ে চেপে ধরে। অতঃপর বুকে ও পায়ে গুলি চালায়। বুট দিয়ে তাঁর বুকে কয়েকটি লাথি মারে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে আবারও শহীদের দেহকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় ঘাতক স্বৈরাচারের দোসর নরপিশাচ পুলিশ বাহিনী। লাশ মেলে ঢামেকে লাশ খুঁজে না পেয়ে তাঁর মা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন। অতঃপর বিজ্ঞপ্তি দেখে এক ব্যক্তি ফোন করে জানায়- ‘আপনার ছেলের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের বাইরে পাওয়া গিয়েছে। আপনারা দ্রুত আসেন।’ পাগলের মত হয়ে যায় শহীদের মা। অতঃপর লাশ বুঝে পায় শহীদ অন্তরের মা ও খালা। ছেলের জখম শরীর দেখে মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন হামিদা বানু। দাফনের স্মৃতিপট একমাত্র ছেলের লাশ বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে অঝরে কাঁদেন দুখিনী মা। ছেলের লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েন তাঁর মমতাময়ী মা। অতঃপর প্রতিবেশীদের সাহায্যে লাশ বাড়িতে আনতে সক্ষম হন তিনি। বারবার বলতে থাকেন- আমার বুকেড় ধন কাইড়া নিলি রে, আমার জানকে ছাড়া কেমনে থাকুম রে।’ মাত্র পনের বছরে থামে শহীদ অন্তরের জীবন। ডগাইর নতুন পাড়া মসজিদে জানাজা শেষে যাত্রাবাড়ীর ডগাইর কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হন শহীদ আশরাফুল ইসলাম অন্তর। শহীদ সম্পর্কে খালার অভিমত অন্তর আমার কাছেই বড় হয়েছে। তাঁর টেকনিক্যাল জ্ঞান খুব ভালো ছিল। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নষ্ট হয়ে গেলে কিভাবে যেন ঠিক করে ফেলত। আমি তার খালা হলেও আমাকে আদর করে মা বলে ডাকত। আমরা পাঁচ বোন। সবাই অন্তরকে আদর করতাম। অন্তরের মৃত্যুতে যেন আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি, বোনের সন্তান নয়। যে আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে তার যেন ফাঁসি হয়। আমি তার বিচার চাই। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ১২ মে ২০০৯ ও (১৫) আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল: ০৫:১০টা শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী দাফন করা হয় : যাত্রাবাড়ী ডগাইর কবরস্থান কবরের জিপিএস লোকেশন : ২৩ক্ক৪২’৩৬,৪'ঘ৯০ক্ক২৮'৩১.৬’’ঊ’২৩.৭১০০৯৮,৯০.৪৭৫৪৫১ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বানিয়াল, আশালির চর উপজেলা: মুন্সিগঞ্জ সদর, জেলা: মুন্সিগঞ্জ পিতা ও মাতা : মিজানুর রহমান, হামিদা বানু (বৈবাহিক বিচ্ছেদ হয়েছে, শহীদের সকল দায়িত্ব মা পালন করেছেন) ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : টিনের তৈরি পৈতৃক বাড়ি আছে, আবাদি জমি নেই ভাইবোনের বিবরণ : একমাত্র বোন: ফারিয়া, বয়স: ১ বছর, (মায়ের কাছে আছে) প্রস্তাবনা ১. শহীদের মাকে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. ঋণ পরিশোধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে ৩. শহীদের একমাত্র বোনকে এতিম প্রতিপালনের আওতাভূক্ত করা যেতে পারে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর
Image of মো: আশরাফুল ইসলাম অন্তর

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

রুদ্র সেন

মো: নুরুজ্জামান

মো: সুমন পাটয়ারী

মো: আজিজুল ইসলাম

মো: শাহরিয়ার আল আফরোজ শ্রাবন

মো: রুবাইদুজ্জামান রেজওয়ান নাইম

আব্দুল লতিফ

লাবলু মিয়া

আল শাহ রিয়াদ

মো: তৌফিক ইসলাম ভূঁইয়া

মো: সুমন ইসলাম

মো: শাহাবুল ইসলাম ( শাওন )

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo