জন্ম তারিখ: ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৫ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা: শ্রমিক, তানিয়া ডাইং কোম্পানি শাহাদাতের স্থান : নরসিংদির সদর হাসপাতাল
শহীদ জামাল মিয়া ২০০৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার অন্তর্গত দেউল ডেঙরা গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং মোসাম্মৎ মিনা আক্তার দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে শহীদ জামাল মিয়া তৃতীয়। তার বড় দুই ভাই এবং ছোট দুই বোন রয়েছে। পিতা মাতার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে হাফেজে কোরআন বানাবেন। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ছোট্টবেলা থেকেই তাকে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করান এবং শহীদ জামাল সাত পারা কোরআনে হাফেজও হয়েছিললেন। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে পড়াশুনা এগিয়ে নিতে পারেননি। পরিবারকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য তিনি নরসিংদীর তানিয়া ডাইং কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন।পরিবার সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশের আর দশটা দরিদ্র পরিবারের মতোই শহীদ জামালের পরিবারও ছিল অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। তিন পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ করতে সংগ্রাম করতে হয়েছে শহীদের দরিদ্র পিতাকে। স্বভাবতই সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে পারেননি। শহীদের বড় ভাই মোঃ রায়হান মিয়া একজন গরুর ফার্ম শ্রমিক এবং শহীদের ইমিডিয়েট বড় ভাই মোহাম্মদ আরমান সে ও একজন শ্রমিক। শহীদ জামালকে আলেম বানানোর জন্য পিতামাতার স্বপ্ন থাকলেও দারিদ্রতার কারণে সেটাও সম্ভব হয়নি। শহীদ সম্পর্কে তার চাচার মন্তব্য, " জামাল অনেক ভালো ছেলে ছিল। বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিত। বাবা, মা, ভাই-বোনের সাথে যোগাযোগ রাখত সবসময়। গ্রামের মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসত। " শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন জামাল মিয়া শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ন্যায় আর মানবিকতার এই সংগ্রামে তার মতো শ্রমিকদের উপস্থিতি এক নতুন শক্তি এনে দেয়। ২১ জুলাইয়ের দুপুর ছিল এক অভিশপ্ত সময়, যখন শহীদ জামাল মিয়া নরসিংদির রাস্তায় তার কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। সময় তখন দুপুর ১২টা। হঠাৎ করে গুলির শব্দ শোনা যায়, আর সেই সাথে থেমে যায় তার জীবনযাত্রার ছন্দ। রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। গুলি তার পেটের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। রাস্তায় রক্তাক্ত জামাল মিয়ার নিথর দেহ পড়ে থাকে প্রায় ২/৩ ঘণ্টা ধরে। কেউ এগিয়ে আসেনি, কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তার জীবনপ্রদীপ নিভতে থাকে। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় যেন তার জীবনটা উপেক্ষিত এক গল্প হয়ে যায়, তার কষ্টের সাক্ষী শুধু সেই রক্তাক্ত পথ আর প্রকৃতির নীরবতা। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর, তার একজন আত্মীয় ঘটনাস্থলে এসে তাকে দ্রুত নরসিংদির সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর তার শারীরিক অবস্থা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। চিকিৎসকরা তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন, তার জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের বেডে শুয়ে থাকা জামাল মিয়া তখনও কিছুটা কথা বলতে পারছিলেন। তিনি জানতেন না, এই কথাগুলোই হতে যাচ্ছে তার জীবনের শেষ কথা। তার প্রতিটি শব্দ ছিল বেদনাবিধুর, তবুও ন্যায়ের পক্ষে তার মনোবল অটুট ছিল। একসময়, সেই কথার স্রোত থেমে যায়। ধীরে ধীরে তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জীবনের জন্য তার লড়াইও থেমে যায়। যন্ত্রণা এবং বেদনার মধ্যে দিয়ে ২৫ জুলাই সকাল ৮ টা ৫০ মিনিটে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার এই মৃত্যু ছিল শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়; এটি ছিল একজন নায়কের আত্মত্যাগ, এক শ্রমিকের সংগ্রামী চেতনার অমর সাক্ষর। শহীদ জামাল মিয়া আর বেঁচে নেই, কিন্তু তার গল্প বেঁচে থাকবে চিরকাল। তার রক্তাক্ত দেহ, তার সংগ্রাম, তার ত্যাগ-এগুলো সবই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মশাল হয়ে জ্বলবে। এই মশাল ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়াই করা নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে। প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা। ২. শহীদের বৃদ্ধ পিতার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ৩. শহীদের বড় দুই ভাইয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া। ৪. এদের ছোট বোনের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করা। এক নজরে শহীদ মোঃ জামাল মিয়া নাম : মো: জামাল মিয়া, জন্ম : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ পিতা : মো: শহিদুল ইসলাম, বয়স : ৬০ বছর, পেশা : শ্রমিক মাতা : মোসাম্মৎ মিনার আক্তার, বয়স : ৪৫ বছর ভাই বোন : তিন ভাই দুই বোন, ভাই বোনের মধ্যে শহীদের অবস্থান তৃতীয় আহত হওয়ার স্থান : নরসিংদী আঘাতের ধরণ : ঘাতক পুলিশের গুলি পেটের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বের হয়ে যায় যাদের আক্রমণে আহত হয় : পুলিশ ও বিজিবি আহত হওয়ার তারিখ : ২১ জুলাই দুপুর ১২ টা শাহাদাতের তারিখ : ২৫ জুলাই সকাল ৮:৫০টা